- তৈমূর আলম খন্দকার
- ২৫ নভেম্বর ২০২২
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি দেশব্যাপী প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করে যাচ্ছে, সব কিছু ঠিক থাকলে যার পরিসমাপ্তি ঘটবে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা গ্র্যান্ড মহাসমাবেশের মাধ্যমে। বিভাগীয় সমাবেশগুলো মহাসমাবেশে রূপ নিয়েছে। সরকারি মুখপাত্র বলছে দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই বিএনপি বড় বড় সমাবেশ করতে পারছে। বাস্তবে কি তাই! সরকারের এ বক্তব্য কি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে? বরং সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের বিভিন্ন কূটকৌশল বুমেরাং হয়েছে।
কথা নাই, বলা নাই বিএনপির সমাবেশ আসলেই পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়, আবার সমাবেশ শেষ হওয়া মাত্রই পরিবহন চালু। কার নির্দেশে পরিবহন বন্ধ ও চালু হচ্ছে এটা কি দেশের জনগণ বোঝে না? জনগণকে এত বোকা ভাবার কারণ কী? পরিবহন বন্ধে জনগণের ভোগান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, কিন্তু বিভাগীয় সমাবেশে গণ-উপস্থিতি কি কমতি হয়েছে? বরঞ্চ সরকার থেকে উল্টো বলা হয় যে, মহাসমাবেশ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনদুর্ভোগের জন্য জনগণ কাকে দায়ী করছে, সরকার কি তা ভেবে দেখেছে? প্রকৃত গোয়েন্দা রিপোর্ট কোনো দিনই সরকারের নিকট পৌঁছায় না। সরকার শুনতে যা পছন্দ করে সে ধরনের কথাই গোয়েন্দারা সরকারের কানে পৌঁছায় এবং এটাই তাদের দীর্ঘদিনের ট্র্যাডিশন। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের নিজেদের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ পলিটিক্স থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দু’জন জঙ্গির সহজেই পলায়ন সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর একটি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা।’ অরাজনৈতিক ব্যক্তি ক্ষমতা পেলে যা বলেন তিনি অনুরূপই মন্তব্য করেছেন এবং ইতঃপূর্বেও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি এরকমই বলেছেন। সম্প্রতি পুলিশ ও প্রশাসনে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের বিষয়টিও আমলাতন্ত্রে সরকারবিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট চালু হয়েছে বলেও কিছুটা আঁচ করা যায়। উল্লেখ্য, অত্র আর্টিকেল লেখা পর্যন্ত একজন সচিবসহ সাতজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকায় আরো অনেক কর্মকর্তার নাম রয়েছে বলে ধারণা করা যায় এবং লোকমুখে এমনই শুনা যাচ্ছে। বিএনপির মিটিং এ কেন দিন দিন লোকসমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় সরকারের বোধগম্য হওয়া উচিত ছিল, তার পরিবর্তে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী টিপ্পনী কেটে জনগণের নিকট একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
বিভাগীয় সমাবেশে জনসমাগম বেশি হওয়ার কারণ হলো সরকারের সব ব্যর্থতা বিরোধী দলের তথা বিএনপি’র অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। সরকারের করা পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রভৃতি উন্নয়ন জনগণের কাছে ম্লান হয়ে যায় যখন জনগণ বিভিন্নভাবে সরকার দ্বারা ভোগান্তির শিকার হয়। কাগজ ও ওষুধসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, মানিলন্ডারিং, মাদকের প্রসার, সরকারি সুবিধা, নিয়োগ ও প্রমোশনে বৈষম্য প্রভৃতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধিসহ সরকারি ঘরানার লোকদের দ্বারা ব্যাংক লুটের কাহিনী, তদুপরি স্থানীয়ভাবে রয়েছে এমপি-মন্ত্রীদের রাম রাজত্ব। এমপির আওতাধীন প্রতিটি থানার ওসি এবং টিএনওর যেকোনো সিদ্ধান্ত এমপির মুখের দিকে তাকিয়ে নিতে হয়। এমপি ও তাদের লোকজনের মনোরঞ্জন করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। এমপির বাহিনীকে ভাগ দেয়া ছাড়া বৈধ বা অবৈধ কোনো ব্যবসা করা যায় না। ফুটপাথের হকার থেকে শুরু করে টেম্পোওয়ালারা পর্যন্ত এমপির বাহিনীকে মাসোহারা দিয়েই রুটি রুজির কাজ করতে হয়।
বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে যুবসমাজের একটি বৃহৎ অংশ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মাদক এখন নিম্নবিত্ত থেকে অভিজাত শ্রেণীর ঘরে ঘরে। যে পরিবারে একজন মাদকাসক্ত রয়েছে সে পরিবারটি ভয়াবহ দুর্যোগে রয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ শুনে আসছি যে, আমার নিজ পিতৃভূমি রূপগঞ্জের (নারায়ণগঞ্জ) চনপাড়া বস্তি থেকে রাজধানীসহ আশপাশের জেলায় মাদক সরবরাহ হয়। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র ফারদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চনপাড়ার গোপন রহস্যসহ গডফাদার ডনের নাম পরিচয় বেরিয়ে আসে। এ ছাড়াও রয়েছে মাদকসহ সব অবৈধ ব্যবসায় কল্পকাহিনীসহ মাদক সম্রাট ডনের অবৈধ সম্পদের বিবরণ। র্যাবের ভাষ্য মতে, ডনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা রয়েছে। অথচ এ ডনকে সশস্ত্র মহড়ায় বডি গার্ডসহ চলাফেরা করাসহ স্থানীয় মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। ডন একদিনে তৈরি হয় না। ক্ষমতা বা এমপি-মন্ত্রীদের ছত্রছায়া ছাড়া ডন সৃষ্টি হয় না। ঘটনার বিবরণীতে বুঝা যায় যে, চন পাড়াতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুধু রূপগঞ্জ নয় দেশব্যাপী এমনি বহু ডনবাহিনী রয়েছে এমপি-মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয়ভাবে নির্যাতিত জনগণও প্রতিশোধের আগুনে এমপি-মন্ত্রীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যার প্রতিফলন সরকারকেই মূল্য দিয়ে ভোগ করতে হবে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না, অনুরূপ উন্নয়নের বিনিময়ে নির্যাতিত ব্যক্তির মন পাওয়া যাবে না। রূপগঞ্জের সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদক রাজত্বের কাহিনী বহুবার পত্রিকায় প্রকাশ করলেও পুলিশ ও প্রশাসন এ বিষয়টি নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। গডফাদার ডন থেকে পুলিশ নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে। মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে পুলিশের অনেক লোক জেলে আছে। মাদক ব্যবসার কারণে কক্সবাজারের বদিকে পুনরায় এমপি নমিনেশন না দিয়ে তার স্ত্রীকে এমপি বানিয়েছে। মাদক নির্মূলে সরকারের এহেন দ্বিমুখী নীতি জনগণ পছন্দ করেনি।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। সরকারি দলের নেতারা তাদের ছাড়া সবাইকেই সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চিহ্নিত করে নিজেদের ছায়ার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের সব মানুষই মুক্তিযোদ্ধা, হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি ছাড়া যারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সমর্থন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার মনে করে। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানের কথা ন্যূনতমও তারা স্বীকার করে না, বরং পাকিস্তানের চর বলে, অথচ জেনারেল জিয়াকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব আওয়ামী লীগ সরকারই দিয়েছিল। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের এহেন মনোভাব ও প্রপাগান্ডা জনগণ ভালো চোখে দেখছে না।
লোডশেডিং অব্যাহত থাকাবস্থায়ই পত্রিকায় প্রকাশ পাইয়াছে যে, কর্তৃপক্ষ বিদ্যুতের মূল্য ২০% বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়াও শিশুখাদ্য, চিনি, ভোজ্যতেলসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ঊর্ধ্বগতির কারণে জনগণকে সরকার তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। তীর আটা দুই কেজির মূল্য ১৪৫ টাকা, ৬০ টাকার চিনি ১২০ টাকা, মসুর ডাল ৯০ টাকার স্থলে ১৪০ টাকা। দ্রব্যমূল্য যখন নাগালের বাইরে চলে যায় তখন মেট্রোরেলে চড়ার সুখ আর মনে লাগে না।
প্রচার পাচ্ছে যে, রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে, ব্যাংকের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, ১০টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ব্যাংক লুটের পেছনে সরকারি ঘরানার হাত আছে বলে জনগণ মনে করে। মানিলন্ডারিং নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান নিজে স্বীকার করেছেন। পাচার হওয়া লক্ষ কোটি টাকার একটি টাকাও সরকার বিদেশ থেকে ফেরত আনতে পারে নাই। মানিলন্ডারিং সরকারি লোক দ্বারা হচ্ছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যচ্ছে না বলে জনগণের একটি বদ্ধমূল ধারণা। বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো তথা নির্বাচন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত আমলাতন্ত্র অকেজা। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে যে, সাংবিধানিক ও নিরপেক্ষ জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে চারটি ইংরেজি ‘C’ এর কারণে যথা (১) Collusion (গোপন আঁতাত), (২) Corruption (দুর্নীতি), (৩) Clientism (স্বজনপ্রীতি), (৪) Caprice (নীতিবহির্ভূত কর্ম)। যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দলমত নির্বিশেষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার আইনগত বিধান রয়েছে সে প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ মাসদার হোসেন মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণক্রমে ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু বিচার বিভাগ কি নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছে? সরকারি আগ্রাসন তথা গায়েবি মোকদ্দমা থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য বিচার বিভাগ কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পেরেছে? সম্প্রতি সমাবেশগুলো সফল হওয়ার সাথে সাথে গায়েবি মোকদ্দমার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার জন্য গায়েবি মোকদ্দমাই প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনও কি সেভাবেই হবে?
বিএনপি করে না, কিন্তু সরকারকে সমর্থন করে না এমন লোকও গায়েবি মোকদ্দমায় আসামি হয়ে কারাবরণ করেছে। এমনিভাবে জনগণকে সরকার প্রতিপক্ষ বানিয়েছে বিধায় সমাবেশ এখন মহাসমাবেশে পরিণত হচ্ছে।
আপিল চলাকালে অনেকেরই জামিন হয়। বিচার চলাকালে জামিনে থাকলে আপিলে জামিন পাওয়ার একটা গ্রাউন্ড। তাছাড়া অসুস্থ, নারী, বয়স্ক হলে জামিন দেওয়ার আইন বিদ্যমান। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া বিচার চলাকালে জামিনে ছিলেন, তাছাড়া তিনি একজন অসুস্থ বয়স্কা নারী। তার পরও চেয়ারপারসনের জামিন না হওয়ায় প্রশ্নে সাধারণ মানুষ সরকারের অযাচিত প্রভাবকেই দায়ী করছে। এ ধরনের অনেক কর্মকাণ্ড সরকারের উন্নয়নের ভাবমূর্তিকে ম্লান করে দিয়ে বিরোধী দলের প্রতি জনগণের সমর্থনের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com