মাহমুদুর রহমান :
আজ ছাব্বিসে মার্চ। বাংলাদেশে মহা সমারোহে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এবারের আয়োজনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার “ডামি নির্বাচনের” সরকার ভুটানের রাজাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। হাসিনার “পায়ের ধুলাসম” তুচ্ছাতিতুচ্ছ রাষ্ট্রপতি চুপ্পু গতকাল ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভুটানের রাজাকে স্বাগত জানিয়েছেন। অপমান করবার জন্য অতি নিম্ন শ্রেণির এই চোর, চুপ্পুকে হাসিনার পায়ের ধুলাসম আমি বলি নাই। চুপ্পুরও আবার অপমান! কারো মান থাকলে তবেই না অপমানের প্রশ্ন আসে। বছর খানেক আগে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে মিডিয়ায় নাম ঘোষণা হওয়ার পর আনন্দের আতিশয্যে, চুপ্পুর প্রথম মন্তব্যের কথা গত পনেরো বছরে ভাবলেষহীন রোবটে রূপান্তরিত হওয়া, বাংলাদেশের জনগণের নিশ্চয়ই স্মরণে নাই। চুপ্পু সেদিন বলেছিলেন, “আমার দু:খ হচ্ছে যে, প্রটোকলের কারণে আমি বঙ্গবন্ধু কন্যার পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারছি না”। যাই হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ভুটানের রাজার উপস্থিতি ভূরাজনৈতিক কারণে বিশেষ অর্থবহ।
হিমালয়ের রাজ্যটি সম্পর্কে একটি কঠিন মন্তব্য দিয়ে আরম্ভ করছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভুটান বর্তমানে পুরোপুরি স্বাধীন কোন রাষ্ট্র নয়। আসলে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে ভুটান কোনদিনই স্বাধীনতা পায় নাই। এক সময় ভুটান কেবল স্বাধীন নয়, যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। ১৭৭২ সালে ভুটানের সেনাবাহিনী কুচবিহার পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। কুচবিহারের রাজা তখন সাহায্যের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আবেদন জানায়। সেই ভুটান-কুচবিহার যুদ্ধের ধারাবাহিকতায়, ১৯১০ সাল পর্যন্ত বৃটিশদের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের ফলে পর্যুদস্ত ভুটানের রাজা ঔপনিবেশিক শাসন মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৯১০ সালের “পুনাখা চুক্তি”ক্রমে ভুটানকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধিনস্থ ভারতের “Princely State” এর সমমর্যাদা দেয়া হয়। অর্থাৎ ভুটানের স্বাধীনতার অবসান ঘটে। হিমালয়ের রাজ্যটির হারানো স্বাধীনতা আর ফিরে আসে নাই।
১৯৪৯ সালে ভুটানের হাত মুঁচড়ে ভারত সরকার যে চুক্তি করতে দেশটিকে বাধ্য করেছিল সেটি প্রকৃতপক্ষে, উপরে উল্লিখিত ১৯১০ সালের বৃটিশ “হেজেমনিক” চুক্তিরই সম্প্রসারণ ছিল। পাঠকদের জানিয়ে রাখছি, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বিদেশে ভুটানের কোন দূতাবাস স্থাপনের অধিকার ছিল না। মজার কথা হলো, ভুটানের প্রথম দূতাবাসটি দিল্লিতে স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ, মালিকের জমিতে, মালিকেরই নিয়ন্ত্রণে, প্রজার জন্য একটি ক্ষুদ্র ঘরের ব্যবস্থা হয়। ১৯৭১ সালে ভারতের অনুমতিক্রমে ও উদ্যোগে ভুটানকে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। তারখটি ছিল, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
দীর্ঘ বাইশ বছর টালবাহানার পর একটি বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনে, দিল্লি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভুটানকে জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। ওই সময় ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। ভুরাজনৈতিক কারণেই ভারতের জাতিসংঘে আজ্ঞাবহ ভুটানকে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। ৩ ডিসেম্বর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ভুটান স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৪৯ সালের চুক্তিমোতাবেক ভুটানের স্বাধীন কোন পররাষ্ট্রনীতি আজও নাই। কাজেই ভারতের নির্দেশেই ভুটান সেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন যে, অন্য যে কোন একটি দেশ স্বীকৃতি দেয়ার পর তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। ভুটানকে ইন্দিরা গান্ধীর দাবার বড়ে হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ভুটানের পর ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার জন্য ভুটানকে সম্ভবত: আরো বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হত। সেদিক দিয়ে দেশটি লাভবান হয়েছিল। ভুটান সম্পর্কে শেষ তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস প্রসঙ্গে ফিরব। ভারত আজ পর্যন্ত ভুটানকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের কারো সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবার অনুমতি দেয় নাই। দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, এবং ফ্রান্সের কোন দূতাবাস নাই। ভুটানেরও কোন দূতাবাস ওই পাঁচ দেশে নাই। প্রধানত: হিমালয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকানোর জন্যই ভারতের এই আয়োজন। আলোচনার শুরুতে কেন ভুটানকে আমি স্বাধীন দেশ বলি নাই সেটা আশা করি পাঠক বুঝতে পারছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার হাল ভুটানের চেয়েও করুণ।
ভুটান কোন দিনই স্বাধীনতা পায় নাই। আর হতভাগ্য, মেরুদন্ডহীন বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা পেয়েও হারিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাঙ্গালীত্ব অর্জনের সাথে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যদি সেদিন আজকের বৃষ্টি খাতুনের মত মুসলমানিত্ব বিসর্জন দিয়ে অভিশ্রুতি হতে পারতো তাহলে স্বাধীনতার ভড়ংয়ের আর দরকার হতো না। সেই সময়ই আমরা “ভারত মাতার” পদতলে বিলীন হয়ে যেতে পারতাম। সার্বিক বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটি তখন সম্ভব হয় নাই। উল্টো পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর হঠাৎ করেই কেন যেন সদ্য স্বাধীন দেশের জনমানসে ইসলাম আগের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি দিল্লির নজর এড়ায় নাই। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা বাড়িয়ে, শকুনের চোখ নিয়ে তারা অপেক্ষা করেছে।
বিগত পঞ্চাশ ধরে বাংলাদেশে সেক্যুলারিত্বের নামে সমাজের সর্বত্র ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে বৃটিশ আমলের হিন্দু চরিত্রদের নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুসলমান নামগুলো ক্রমশ: শিক্ষিত, বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে আজকের প্রজন্মের এক বিরাট অংশ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, কবি আলাওল, বাঁশের কেল্লার তীতুমির, বিপ্লবী সিপাহি রজব আলীকে না চিনলেও, সূর্য সেন, প্রীতিলতাদের বিনীত মস্তকে পূজা করতে শিখেছে। প্রথম আলো জাতিয় মিডিয়া এবং সেক্যুলারের মুখোসে হিন্দুত্ববাদী নাট্য, টেলিভিশন ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী মধ্যবিত্ত সমাজমানসের হিন্দুকরণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ফলে, ২০২৪ সালের বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ভারতে মোদি সরকারের চেয়েও কঠিনভাবে মুসলমানের ধর্ম এবং সংস্কৃতির উপর আঘাত হানতে পারছে।
আমি চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে রোজা রাখতে শুরু করেছি। কিন্তু পবিত্র রমজানের মাসে প্রতিদিন পরিবারের রোজাদার সদস্য ও বন্ধুদের সাথে ইফতার করার জন্য কাজ ফেলে বাসায় ছুটে গেছি। ইফতার কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি বাঙ্গালী মুসলমানের সংস্কৃতির অংশ। সেই ইফতারকে শেখ হাসিনা আজ এক প্রকার বিতর্কিত কাজ হিসেবে দেখানোর সাহস পেয়েছেন। তার নির্দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একসাথে বসে ইফতারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। রোজার মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সেখানে হিন্দুত্ববাদী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করে রোজাদার ছাত্রদের গুরুতরভাবে আহত করেছে। হামলাকারীদের গ্রেফতারের নির্দেশদানের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রমজান মাসে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা যাবে না বলে সার্কুলার দেয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।
একই সময়ে ভারতের গুজরাটে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। গুজরাট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য। সেখানকার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদেশি মুসলমান ছাত্রদের তারাবীর নামাজে কট্টর হিন্দু সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের মতই হামলা চালায়। ওখানে অধ্যয়নরত আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, আফগানিস্তান, এবং উজবেকিস্তানের ছাত্ররা সেই হামলায় আহত হলে বিব্রত ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্তত: লোকদেখানো দু:খ প্রকাশ করেছে। কয়েকজন হামলাকারীকে গ্রেফতার করতেও বাধ্য হয়েছে গুজরাটের বিজেপি সরকার। ২০০২ সালে এই গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেই হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশুকে পুড়িয়ে মেরে নরেন্দ্র মোদি রাতারাতি হিন্দুত্ববাদী ভারতের অবতার হয়ে উঠেছিলেন। কিছুদিন আগে বিবিসি নরেন্দ্র মোদির “গুজরাটের কসাই” হওয়ার ইতিহাস নিয়ে এক ডকুমেন্টারি বানিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তারা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের চাইতেও অসহায় অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালে শুধুমাত্র ভারতের একচেটিয়া সমর্থনের জোরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রীতিমত অবজ্ঞা করেও সার্থকভাবে “ডামি নির্বাচন” করে ফেলার সুবাদে শেখ হাসিনা এবার বাংলাদেশকে দ্রুততার সাথে চূড়ান্ত হিন্দুকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছেন। ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্ট (রাজনীতিবিদ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবি এবং মিলিটারি) এখনও যেহেতু চরম ইসলামবিদ্বেষীদের দখলে রয়েছে, তাই শেখ হাসিনা ধরে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করলে মার্কিন প্রশাসন তাকে বরং মৌন সমর্থন দেবে। এদিকে বাংলাদেশের আলেম সমাজের ইমানের চরম দূর্বলতা এবং লজ্জাজনক সুবিধাবাদিতার ফলে স্বদেশে তাদের কাছ থেকেও হিন্দুত্ববাদীদের কোন বিরোধিতার আশঙ্কা নাই বললেই চলে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা যতই বলুন না কেন, দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করবার জন্য তারা নাকি পিন্ডির শৃঙ্খল ছিন্ন করেন নাই, বাস্তবতা ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে।
২০২২ সালে সমাপ্ত আমার পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম ছিল, “The Rise of Indian Hegemon and Security of Small States in South Asia: A post-1947 Study”। প্রায় দুই বছরের একাডেমিক গবেষণাশেষে আমার মূল সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ:
১) বৃটিশ শাসনের অবসান থেকেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় এক আগ্রাসী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে একক প্রভূত্ব কায়েম করতে চেয়েছে।
২) পাকিস্তান সাধ্যমত ভারতের আঞ্চলিক প্রভূত্বের প্রয়াসকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ১৯৭১ সালে দ্বিখন্ডিত হওয়া এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক দূর্বলতা সত্ত্বেও ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান আণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে যাওয়াতে উপমহাদেশের পশ্চিম অংশে ভারতকে “হেজেমনিক কন্ট্রোল” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অসমাপ্ত রেখেই আপাতত: পিছু হঠতে হয়েছে।
৩) নেপাল এবং শ্রীলংকা যথাক্রমে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হলেও ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। বিশাল ভারত জুজুর ভয়ে তারা কোনদিন নুয়ে পড়ে নাই। বরং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত হয়ে ১৯৯০ সালে শ্রীলংকা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
৪) ভারত ব্যতিত পুরো অঞ্চলের সাত দেশের মধ্যে (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ) আণবিক শক্তিধর আগ্রাসী দেশটি কেবল ভুটান এবং বাংলাদেশের উপর তার প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। উভয় দেশই কার্যত: ভারতের অধিনস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ পরবর্তী উপমহাদেশে ভুটান প্রথমাবধি ভারতের বশ্যতা স্বীকার করেছে। বিগত দুই দশকের মধ্যে একদা স্বাধীন বাংলাদেশকেও ভারত করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর এক বিশাল দেশ হয়েও আমাদের স্বদেশ বিস্ময়কর ও লজ্জাজনক কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে বিনা প্রতিরোধে দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, বাংলাদেশের জনগণের অর্থে প্রতিপালিত, কথিত “দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী” বিশ্বাসঘাতকতা করে ভারতের “ট্রয়ের ঘোড়ার” ভূমিকা পালন করেছে। সেনা বাহিনীর জেনারেলরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক নামক ভারতীয় এজেন্টদের সাথে দাঁড়িয়ে সমস্বরে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র”, সেনাবাহিনীর প্রধানসহ সিভিল, মিলিটারি এবং জুডিশিয়ারির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের এজেন্টদের বসিয়েছে। এই অবস্থায়, দিল্লির কাছ থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কোন নৈতিক ভিত্তি আছে কিনা পাঠকরাই বিবেচনা করুন। জনগণ চাইলে অবশ্যই জাকজমক সহকারে ভারতের বিজয় দিবস পালন করতে পারে।
আমার এই জীবনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং বিসর্জন দুটোই প্রত্যক্ষ করেছি। স্বদেশ নিয়ে হতাশা বোধ করলেও অনেক দূরের প্যালেস্টাইনের লড়াকু জনগণের মহান প্রতিরোধ সংগ্রাম আমাকে উদ্বেল এবং অনুপ্রাণিত করে। প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে তারা অসম লড়াই করতে বাধ্য হলেও অদ্যাবধি ভারতের হিন্দুত্ববাদের (Hindutva) সমচরিত্রের এক অতি চরমপন্থী, আগ্রাসী, নিষ্ঠুর ও বর্ণবাদী জায়নবাদের (Jewish and Christian Zionism) কাছে পরাভব মানে নাই। মাত্র পঁচিশ লাখ প্রায় নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত প্রবল শক্তিশালী, নির্মম জায়নবাদী War Machine কে গাজায় ছয় মাস ধরে প্রতিহত করে যাচ্ছে। প্যালেস্টাইনের জনগণের তুলনায় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা এ যাবত অতি সামান্যই মূল্য দিয়েছি। তাই গাজার শিশু, নারী ও পুরুষের মহান লড়াই আমার আদর্শ। Long live Palestine। প্যালেস্টাইনের জয় হোক। আশা করি, প্যালেস্টাইনের মহান সংগ্রাম বাংলাদেশের জনগণকেও একদিন হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক লড়াইয়ে অনু্প্রাণিত করবে। সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ