দেশের পণ্য রপ্তানির হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। এতে পণ্য রপ্তানির ২ হাজার ৩৩৪ কোটি বা ২৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের হদিস মিলছে না। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস ও এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস মিলিয়ে মোট ২০ মাসে ৯ হাজার ৩১৪ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বলছে, ওই সময় রপ্তানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার। তার মানে ২৫ শতাংশ রপ্তানির তথ্য উধাও হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো জবাবও পাওয়া যায়নি।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেটিই সত্য হলো। এত দিন রপ্তানি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। এতে নীতিনির্ধারকেরা ভুল বার্তা পেয়েছেন। শিল্পের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রপ্তানির হিসাব দেশের লেনদেন ভারসাম্য ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব ফেলে। তাই দেরিতে হলেও প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশের উদ্যোগটি ইতিবাচক।
এদিকে পণ্য রপ্তানির ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের হিসাব কোথায় গেল, সে বিষয়ে নিশ্চুপ আছেন ইপিবির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দু-তিন বছর ধরে সংস্থাটি রপ্তানির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে, তাতে ত্রুটি আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এত দিন ইপিবির তথ্যের ভিত্তিতে রপ্তানির হিসাব করা হতো। কিন্তু ইপিবি যে তথ্য দিচ্ছিল, সেই অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। তবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। তাই এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আর ইপিবি একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে।
রপ্তানির প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বুধবার লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব করেছে। এতে দেশের আর্থিক হিসাব হঠাৎ করেই ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে। তবে নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে চলতি হিসাব। রপ্তানি তথ্যের হিসাবে ওলটপালট হওয়ায় গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৫৫৬ কোটি ডলার।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের। তার মানে ৯৫৪ কোটি ডলারের রপ্তানি কম হয়েছে।
একইভাবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল ইপিবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এই সময়ে প্রকৃত রপ্তানি ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কম। অর্থাৎ রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য।
রপ্তানি তথ্যের গরমিলের বিষয়ে জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনের দপ্তরে যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠকে গেছেন ভাইস চেয়ারম্যান। পরে তাঁর মুঠোফোনে কল করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এ বিষয়ে ইপিবির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দেশের পণ্য রপ্তানির ৮৪-৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। ইপিবির রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের মাঝামাঝি থেকে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানিকারকেরা। তাঁদের অনেকে দাবি করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ হ্রাস পায়। তাতে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ২০-৩০ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। তাতে প্রকৃত রপ্তানিও কম হয়।
কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ইপিবি বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সে সময় সংস্থাটির তথ্যের সঙ্গে এনবিআরের তথ্যের গরমিল দেখা দেয়। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ। ইপিবি ও এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, পোশাক রপ্তানিতে গরমিল ৮৪৭ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। যদিও ইপিবি বলেছিল, এই সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৪ হাজার ৪৯ কোটি ডলার। তার মানে দুই সংস্থার তথ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির হিসাবের গরমিল ১ হাজার ৮১ কোটি ডলারের।
রপ্তানির তথ্যের গরমিল বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই বলছিলাম ইপিবির রপ্তানির হিসাব সন্দেহজনক। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করায় আমাদের ধারণাই সত্য হলো। ভুল তথ্যের কারণে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রকৃত রপ্তানির সঙ্গে অন্য হিসাব যুক্ত করে সেটিকে বেশি দেখানো হয়েছে। হয়তো সেটির ভিত্তিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ৭২৫ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ওই সময় রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের পণ্য। তার মানে এখনো কিছু জায়গায় তথ্যগত বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগটি ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, রিপোর্টিং ত্রুটির পাশাপাশি রপ্তানি অর্থ দেশে প্রত্যাবাসন না হওয়া হিসাবের গরমিলের অন্যতম কারণ। ঋণপত্র ধরে হিসাব করলে রপ্তানি অপ্রত্যাবাসিত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ রয়েছে।
prothom alo