আমার অবুঝ সন্তানের কী হবে?
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
২৬ ডিসেম্বর ২০২২
নাসরিন জাহান চামেলী। পঞ্চগড়ে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে নিহত আব্দুর রশিদ আরেফিনের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর খবর মানতে পারছেন না। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, আর মূর্ছা যাচ্ছেন। মাতম করতে করতে বলছেন, ‘কোথায় গেল আমার স্বামী, কোথায় গেল আমার ছেলের বাবা, আমার এই অবুঝ সন্তানের কী হবে এখন?’ নিহত বিএনপি নেতার বাড়ির আঙিনাজুড়ে শুধু কান্না আর কান্না। স্ত্রী-সন্তান আর মায়ের কান্না যেন কোনোভাবেই থামছে না। প্রিয়জন বারবার শান্ত করার চেষ্টা করলেও হাজারো প্রশ্ন চামেলীর। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার সন্তান এতিম হয়ে গেল। শনিবার পঞ্চগড় জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সংঘর্ষে নিহত হন আব্দুর রশিদ আরেফিন। তিনি ছিলেন ময়নাদিঘি ইউনিয়ন বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক।
স্বজনরা জানান, ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে রশিদ ছিলেন দ্বিতীয়। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ভীমপুকুর ডাঙ্গাপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তবে ওই বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত না হওয়ায় চার বছর ধরে একরামুল হক বিদ্যানিকেতন নামের স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় পাথরাজ বাজারে একটি ওষুধের দোকানও চালাতেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে ও মাকে নিয়ে সংসার তার। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অল্পকিছু জমিতে করতেন চাষাবাদ। এ ছাড়া বছরখানেক আগে মারা যাওয়া বড় ভাই আনোয়ার হোসেনের সংসারটির দেখভাল করতেন তিনি। স্ত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘মাত্র ৩০ দিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন। কয়েক দিন আগে আমি এতিম হলাম, এখন আমার ছেলে এতিম হলো। সে তো অবুঝ শিশু। গতকাল দুপুরে আরেফিনের পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দিতে বাড়িতে যান বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেনসহ বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা। এসময় পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দেন নেতারা। নেতাদের সামনে আব্দুর রশিদের স্বজনদের আহাজারিতে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
পুলিশের ৫ মামলায় আসামি প্রায় ১৩০০
ওদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন পঞ্চগড় জেলার শত শত বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। গণমিছিলের সময় সংঘর্ষের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, মারপিট ও ভাঙচুরের অভিযোগ এনে পুলিশের দায়েরকৃত ৫টি মামলায় ৮১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১১শ’ থেকে ১২শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। একই অভিযান শুরু করার জন্য এ আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গত শনিবার রাতেই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াতের ৮ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে পঞ্চগড় সদরে ১ জন, দেবীগঞ্জে ১ জন, বোদায় ১ জন, আটোয়ারীতে ২ জন ও তেঁতুলিয়ায় জামায়াতের ২ জন। পঞ্চগড় সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল লতিফ মিঞা মামলা ও আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় নিহত বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ আরেফিনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাদ আছর বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি ইউনিয়নের হরিপুর জোত দেবীকান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে হরিপুর চন্দনপাড়া কবরস্থানে আরেফিনের লাশ দাফন করা হয়। জানাজায় পঞ্চগড় জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ, যুগ্ম আহ্বায়ক ও পঞ্চগড় পৌরসভার সাবেক মেয়র তৌহিদুল ইসলাম, দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সদস্য ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, গণমিছিলে আরেফিন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পুলিশের অতর্কিত লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলের আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক সহকর্মীরা আরেফিনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পঞ্চগড় পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, শনিবার বিকালে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা গণমিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এর মাঝে জেলা বিএনপি কার্যালয় থেকে তারা গণমিছিল নিয়ে বের হয়ে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। পুলিশ তাদের বাধা দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ ও বিএনপি’র ২০ থেকে ২৫ নেতাকর্মী আহত হয়। শনিবারের ঘটনায় আব্দুর রশিদ আরেফিন নামে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে তার বাইপাস সার্জারি করা ছিল। পুলিশের গুলিতে নয়, ময়নাতদন্ত শেষে সিভিল সার্জন জানিয়েছেন স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ৮১ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ১১শ’ থেকে ১২শ’ জনকে আসামি করে পুলিশ ৫টি মামলা করেছে। এ ছাড়া বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, মামলায় নির্দোষ মানুষকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।