টমাস মেনি
দীর্ঘদিন ধরে নর্ডিক দেশগুলো নিজেদের নিরীহ, মানবিক ও শান্তিকামী শক্তি হিসেবে দেখে আসছে। এই দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জাতীয় পরিচয় তাদের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। সুইডিশরা তাদের শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে জোটনিরপেক্ষতার চেতনা লালন করে থাকে। অন্যদিকে ফিনিশরা রাশিয়ার সঙ্গে ৮৩০ মাইলের সীমান্ত থাকার পরও তাদের ভৌগোলিক পরিমণ্ডলকে শান্তিপূর্ণ রাখার রাজনৈতিক প্রতিভা দেখিয়েছে।
তবে যেহেতু এ দুটি দেশই এখন আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছে, সেহেতু তারা তাদের সেই ঐতিহ্যিক অবস্থান থেকে সরে আসবে। বিশেষ করে ফিনল্যান্ডকে এখন আরও ‘ইউরোপসুলভ’ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব তারা করছে কিসের বিনিময়ে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী রুশ ও পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে তাল দিয়ে চলেছে। একটি আঁটসাঁট জায়গায় ফিনিশরা ব্যতিক্রমী দক্ষতার সঙ্গে পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে পেরেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দশকে ফিনল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে পশ্চিম ইউরোপের বাকি অংশের সমান্তরাল অর্থনৈতিক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল এবং অনেক বেশি সমতাভিত্তিক সমাজ বজায় রাখতে পেরেছিল। এখন দেশটি পশ্চিমের সঙ্গে একচেটিয়া আলিঙ্গনের মাধ্যমে দুটি পারস্পরিক শত্রুভাবাপন্ন অঞ্চলের (রাশিয়া ও ইউরোপ) সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার আগেকার অনুসৃত সতর্ক কৌশলটি পরিত্যাগ করছে। কারণ, দেশটি ইতিমধ্যে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফিনিশরা নিজেদের একটি ‘পশ্চিমা’ জাতি হিসেবে শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত করল। ফিনিশদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, ন্যাটোতে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী হয়েছে। ফিনল্যান্ডের চিন্তাবিদ ও আইনজ্ঞ মারত্তি কোসেনিওমি আমাকে বলেছেন, ‘আপনি সেই শক্তির সঙ্গে আপস করতে পারবেন না আপনার স্বার্থ যার বোঝার ক্ষমতা নেই। আর সেই শক্তি যদি আপনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিধর হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সেই বিবেচনায় ফিনল্যান্ডের ন্যাটোর সদস্য হওয়া যথেষ্ট যৌক্তিক।’
১৯৫০–এর দশকে মস্কো ফিনল্যান্ডের তেল শোধনাগারে তেল পাঠানো এবং সেই তেলে পরিশোধিত হওয়ার পর তা আবার সেখান থেকে কিনে আনত। এর মাধ্যমে ফিনল্যান্ড আর্থিকভাবে অনেক উপকৃত হয়েছে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ধারাবাহিকতা এখনো আছে। তবে ফিনল্যান্ডের নতুন সিদ্ধান্ত সেই জায়গা থেকে তাকে সরিয়ে এনেছে। এ সত্য সুইডেনের বেলায়ও প্রযোজ্য।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পর আদতেই নিরাপদ হতে পারবে কি না, তা আরেক প্রশ্ন। তাদের ঘোষণার পর ক্রেমলিন থেকে মৃদু তিরস্কার করা হয়েছে এবং উভয় দেশে সামরিক তৎপরতা বাড়ানোর বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার কখনোই এ দুই দেশের বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেনি। দুটি দেশের সঙ্গেই ক্রেমলিনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। অতীতের রাশিয়ান-ফিনিশ সামরিক সংঘর্ষের স্মৃতি থেকে বোঝা যায়, বাইরের কেউ ফিনল্যান্ডে অনুপ্রবেশের বিষয়ে বিবেচনা করলে তাকে নিজের জখম পরবর্তী চিকিৎসার কথা মাথায় রাখা উচিত। কারণ, ফিনল্যান্ড ঐতিহাসিকভাবে তার জনসংখ্যার বিশাল অংশকে একত্র করতে সক্ষম হয়েছে। তারা একে-৪৭ রাইফেলের নিজস্ব সংস্করণও তৈরি করে। তাদের যে সুবিশাল বাংকার সিস্টেম আছে, তা পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাতকে পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
ফিনল্যান্ড-ন্যাটো প্রশ্নে একটি সংবেদনশীল বিষয় হলো, ফিনল্যান্ডের বৃহত্তম সংখ্যালঘুরা জাতিতে রুশ। এই রুশ নাগরিকদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান সংস্থাটি স্পষ্ট করে দিয়েছে, ফিনল্যান্ডের বিদ্যমান রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে থেকেই তারা তাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
তবে কিছু ফিনিশ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, পুতিন ফিনল্যান্ডে বসবাসরত সংখ্যালঘু রুশদের বঞ্চনার অভিযোগকে শত্রুতার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। সম্ভবত রাশিয়া ফিনল্যান্ডের কার্যত ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্য হওয়াকে আরও বড় অজুহাত হিসেবে এখন দেখানোর সুযোগ পাবে।
১৯৯৬ সাল থেকে ফিনল্যান্ড বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোয় আয়োজিত যৌথ ন্যাটো মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে এবং ইরাক, কসোভো ও আফগানিস্তানে ন্যাটো মিশনেও তারা অংশগ্রহণ করেছে। কিছু ফিনিশ রাজনীতিবিদ এখন বিশ্বাস করেন, ফিনল্যান্ড যেহেতু ইতিমধ্যে কার্যত ন্যাটো সদস্য হয়ে আছে, সেহেতু অনেক দেরি হওয়ার আগেই তাদের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া উচিত। তাঁদের যুক্তি হলো, পুতিন ফিনল্যান্ডের প্রকৃত সদস্যপদ পাওয়া বন্ধ করার অজুহাত হিসেবে ফিনল্যান্ডের আধা-ন্যাটো মর্যাদাকে ব্যবহার করতে পারেন। ন্যাটোতে যোগদানের মাধ্যমে ফিনল্যান্ড ‘বাস্তব রাজনীতি’ করার নিজস্ব ক্ষমতার ওপর একটি অস্বাভাবিক আস্থা তৈরি করছে বলে মনে হচ্ছে। ফিনল্যান্ডের অদ্ভুত সূক্ষ্ম বৈদেশিক নীতি রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। এ ধরনের বিদেশনীতি সাধারণভাবে ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পশ্চিমা সমাজে এক অর্থে ফিনল্যান্ডাইজেশন বলতে সাধারণত বৃহত্তর শক্তির আনুগত্যকে বোঝায়। অর্থাৎ এ ধরনের বিদেশনীতিকে সমালোচনার চোখে দেখা হয়ে থাকে।
তবে বেশির ভাগ ফিনিশ নাগরিক এটিকে নিন্দনীয় বলে মনে করেন না। কারণ, বাস্তবিক অনুশীলনে ফিনল্যান্ড ক্রেমলিন এবং ইউরোপের সঙ্গে সমানতালে সুসম্পর্ক রেখে উপকৃতই হয়েছে। ফিনল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী জুহো কোরহোনেন আমাকে বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখলে একটি দেশ কতটা উপকৃত হতে পারে, তার উদাহরণ তৈরি করতেই মস্কো ফিনল্যান্ডকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে।’
১৯৫০–এর দশকে মস্কো ফিনল্যান্ডের তেল শোধনাগারে তেল পাঠানো এবং সেই তেলে পরিশোধিত হওয়ার পর তা আবার সেখান থেকে কিনে আনত। এর মাধ্যমে ফিনল্যান্ড আর্থিকভাবে অনেক উপকৃত হয়েছে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ধারাবাহিকতা এখনো আছে। তবে ফিনল্যান্ডের নতুন সিদ্ধান্ত সেই জায়গা থেকে তাকে সরিয়ে এনেছে। এ সত্য সুইডেনের বেলায়ও প্রযোজ্য।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● টমাস মেনি গটিংজেনের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির একজন ফেলো