- মো: নাজমুল হুদা
- ১২ মে ২০২৩, ২০:৪৫
মানব জীবনে নৈতিকতা এক মহান গুণ বা বৈশিষ্ট্যের নাম। নৈতিকতার কোনো বিশেষ সংজ্ঞা নেই। মানব জীবনের অশালীন বা ক্ষতিকর দিকগুলো পরিহার করে শালীন, কল্যাণকর ও ভালো কাজের সমন্বয়ে মানব চরিত্র গঠনের নামই নৈতিকতা। নৈতিকতা অর্জনের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। সাধারণত মানব শিশু প্রথমে পারিবারিক পরিমণ্ডলেই নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করে থাকে। পিতা-মাতা বা ভাই-বোনের শিখানো জীবনাচরণ মানব শিশু আমৃত্যু কম বেশি পালন করে থাকে। সে কারণে পিতা-মাতাই বা পরিবার হলো নৈতিকতা শিক্ষার প্রধান সোপান। মহানবী সা: মাতাকে মানব শিশুর প্রধান শিক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
নেপোলিয়ন বলেছেন, তোমরা আমাকে উন্নত মা দাও আমি তোমাদেরকে উন্নত জাতি উপহার দেবো। অতঃপর সাধারণত বয়ঃবৃদ্ধি ঘটলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। শিক্ষাজীবনের পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ও শিক্ষকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ছেলেমেয়েরা লালিত হয়ে থাকে। সে কারণে উন্নত মানের নৈতিকতা সম্পন্ন পাঠক্রম ও উন্নত চরিত্রের শিক্ষকদের মাধ্যমেই নৈতিকতা বিকশিত হয়। বর্তমানে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে নৈতিকতা উপেক্ষিত হয়েছে ও নৈতিকতা বিবর্জিত সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে; যে কারণে শিশুরা বিদ্যালয়ে যথাযথ নৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতিতেও নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আগে শিক্ষকরা সেবার মানসিকতা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া শেখাতেন। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে সেবার মানসিকতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা শ্রেণীতে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট ও কোচিং শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছেন। ফলে অভিভাবকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হতে সর্বনিম্ন বিদ্যাপীঠে শিক্ষক নিয়োগের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনৈতিক আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে অযোগ্য শিক্ষকরা বিদ্যাপীঠে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে যোগ্য, দক্ষ ও নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষকদের অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মানের অবনমন ঘটছে। অনেক দেরিতে হলেও ইদানীং এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এ সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক দক্ষ, যোগ্য ও নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের কোনো নিয়ম ছিল না।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপদ্ধতি বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছে। বিভিন্নভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ ও বিদ্যালয় প্রধানের যোগসাজশে এসব নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রকৃত নৈতিক শিক্ষা লাভ করছে না। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাব ও অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের জন্য পরস্পরের মধ্যে মারামারি ও সঙ্ঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। তদুপরি যথেষ্ট নৈতিক শিক্ষা না থাকায় ছেলেমেয়েরা অবাধে নৈতিকতা বিবর্জিতভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তি ও অবাধ মেলামেশার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় এসব ছেলেমেয়েই পাঠ্যজীবন শেষে অনৈতিক জীবনাদর্শ নিয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।
কর্মজীবনে এসব ছেলেমেয়েই রাজনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসা, চাকরিসহ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সমাসীন হচ্ছে। এ কারণে সমাজের প্রত্যেকটি সেক্টরে ক্রমান্বয়ে দুর্নীতির প্রভাব ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দেশে ও সমাজে নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। খাদ্যের দুর্ভিক্ষ হলে সময় ও সুযোগমতো বিদেশ থেকে আমদানি করা যায়। অথচ নৈতিকতা আমদানি করার মতো কোনো বস্তু নয়। নৈতিকতা অর্জন ও লালন করতে হয়। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে সুশীল চরিত্রের মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে যোগ্যতার বিচারে দক্ষতা থেকে নৈতিকতার উপরে জোর দেয়া প্রয়োজন। নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি হলে আদর্শ পরিবার গঠিত হবে। আদর্শ পরিবার সমন্বয়ে আদর্শ সমাজ গঠিত হবে।
আদর্শ সমাজের সমন্বয়ে আদর্শবান ও কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠিত হবে। পবিত্র কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ছলেহ বা আদর্শ ব্যক্তির সংস্পর্শে যাও’। পবিত্র কুরআনে আরো ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমরা সত্যবাদী লোকের সংস্পর্শে যাও’। মূলত আদর্শ শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম উন্নত ব্যক্তির সাহচর্য। মহানবী সা: আল্লাহপাকের নির্দেশে জিব্রাইল আমিনের সাহচর্য থেকে সার্বিক ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম বা মহানবীর সহচররা মহানবীর সাহচর্য থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তাবেইগণ সাহাবায়ে কেরামের সাহচর্য থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে সমগ্র পৃথিবীতে নৈতিক শিক্ষা বিকশিত হয়েছিল। বর্তমানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বপর্যায়ে নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নৈতিকতার এ দুর্ভিক্ষ দূর করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রাজনীতি হতে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরিয়ে দিতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে বদলি ও ওএসডি প্রথা তুলে দিয়ে দুর্নীতির জন্য চাকরিজীবীর পদের অবনমন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
অপর দিকে নৈতিকতা ও দক্ষতার বিচারে উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রপ্রদত্ত ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে হবে। কালোবাজারি ও টাকা পাচারকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অনৈতিকতার আবহ মুছে ফেলতে হবে। বর্তমানে যদিও বা কিছু নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ এখনো সমাজে অবশিষ্ট আছে, বাস্তবে সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। উপরন্তু নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষদেরকে বর্তমানে সমাজে অনেক ক্ষেত্রে উপহাস করা হয়। যেমন রাজনীতি, চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগান না। সে কারণে সমাজে অনেক ক্ষেত্রে এসব লোককে বোকা বলে উপহাস করা হয়। অপর দিকে সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীকে চালাক ও জ্ঞানী বলে সম্মান জানানো হয়। সে কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের কাছ থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে সমাজব্যবস্থা হতে অনৈতিকতার দুর্ভিক্ষ দূরীভূত করতে হলে নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষদের মূল্যায়ন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র নৈতিকতা সম্পন্ন এসব মানুষের কাছ থেকে নৈতিক শিক্ষা ও সেবা লাভ করতে পারবে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ ও গবেষক