নেহেরু যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজী হলেন
ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হবে- এ কথা তারা ১৯৪৫ সাল নাগাদ পুরোপুরি বুঝে গিয়েছিল।
তখনকার ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুনের আগেই ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
সেজন্য ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে কেবিনেট মিশন নামে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে।
এর কয়েক মাস পরেই জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলেও মুসলিম লীগ প্রথমে তাতে যোগ দেয়নি।
অনেক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়।
ইতোমধ্যে কলকাতা এবং নোয়াখালী সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।
সে প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ নতুন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে এসে পৌঁছান।
তখন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগ করা কেবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষকে অখণ্ড রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া।
কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর ইংরেজদের মাথায় ভিন্ন চিন্তাও আসা শুরু করে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে তখন অনেকগুলো বৈঠক করেন ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির তখনকার প্রেসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তার আগে ভারতবর্ষে চলমান হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বন্ধের জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে হবে।
মৌলানা আজাদ মি: মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যকার মত-পার্থক্য অনেক কমে এসেছে।
তখন ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন ভারত ভাগের ক্ষেত্রে বাংলা এবং আসামকে একত্রে রেখেছিল।
কিন্তু কংগ্রেস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে। আসাম এবং বাংলা একসাথে থাকবে কি-না এ নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মত-পার্থক্য শুরু হলো।
দুই পক্ষের মত-পার্থক্য এমন একটি জায়গায় পৌঁছাল যে তখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়ে পড়লো।
মৌলানা আজাদ প্রস্তাব করেছিলেন এ বিষয়টি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপর ছেড়ে দিতে।
কিন্তু তখনকার কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল তাতে রাজী হলেন না। তারা এ বিষয়টিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মধ্যস্থতা চাননি।
এরই মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে।
একদিকে যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে প্রশাসন তখন একটি গা ছাড়া ভাব নিয়েছে।
প্রশাসনে থাকা ইউরোপীয়রা তখন কাজে মন দিচ্ছে না। কারণ তারা বুঝতে পারছিল, যেকোন সময় ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তাই তারা শুধু দিন গুনছিল।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।
এর ফলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে।
কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারলেন, মুসলিম লীগের হাতে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া বিরাট ভুল হয়েছে।
কারণ লিয়াকত আলী খানের অনুমোদন ছাড়া সরদার প্যাটেল একজন চাপরাশিও নিয়োগ করতে পারছিলেন না।
ফলে কংগ্রেস নেতাদের নেয়া সিদ্ধান্তু গুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো।
মৌলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেলের কারণেই এ পরিস্থিতির তৈরি হয়।
কারণ সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজ হাতে রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তর দিয়েছিলেন।
এমন প্রেক্ষাপটে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিলেন।
র্নিবাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, একমাত্র ভারত বিভক্ত হলে এর সমাধান হতে পারে।
মৌলানা আজাদ লিখেছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং উভয়পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই।
মি: মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন।
আর ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারতবর্ষ ভাগ করার জন্য সরদার প্যাটেল আগে থেকেই মানসিকভাবে অর্ধেক তৈরি ছিলেন। মি: প্যাটেল ধরে নিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করা যাবে না।
সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে জনসম্মুখে বলেই ফেললেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজী আছেন। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে সরদার প্যাটেলই ছিলেন ভারতবর্ষ ভাগের স্থপতি।
ভারতবর্ষ বিভক্ত করার ফর্মুলা বিষয়ে সরদার প্যাটেল মনস্থির করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনোযোগ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুর দিকে। এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুবই রাগান্বিত হন।কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে ভারতবর্ষ ভাগ করার বিষয়ে ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন। এ বিষয়ে মি: নেহেরুর রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত মি: মাউন্টব্যাটেন তাঁর তৎপরতা চালিয়ে গেছেন।
কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু শেষ পর্যন্ত কিভাবে রাজী হলেন?
মৌলানা আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে।
প্রথমত; জওহরলাল নেহেরুকে রাজী করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় প্রভাব ছিল। লেডি মাউন্টব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। এছাড়া তাঁর মধ্যে আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল যার মাধ্যমে সে অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতো।
লেডি মাউন্টব্যাটেন তাঁর স্বামীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক সময় যারা প্রথমে তাঁর স্বামীর কাজের সাথে একমত হতে পারতেন না, তাদের কাছে স্বামীর চিন্তা-ভাবনা পৌঁছে দিয়ে তাদের সম্মতি আদায় করতেন।
ভারত ভাগ করার পেছনে নেহেরুর রাজী হবার আরেকটি কারণ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। এ ভারতীয় ব্যক্তি ১৯২০’র দশক থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর একজন বড় ভক্ত এবং মি: নেহেরুও কৃষ্ণ মেননকে খুবই পছন্দ করতেন।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে ভারতবর্ষে যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় তখন মি: নেহেরু কৃষ্ণ মেননকে লন্ডনে হাই কমিশনার নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ মেননের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি ছিল। কারণ ১৯৩০’র দশকের প্রথম দিকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কৃষ্ণ মেনন ভারত সফর করেছিলেন।
১৯৪৬ সালের দিকে কৃষ্ণ মেনন যখন আবার ভারতে আসেন তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে কৃষ্ণ মেননের মাধ্যমে মি: নেহেরুকে রাজী করানো যাবে।
মৌলানা আজাদ যখন জানতে পারলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল মোটামুটি একমত হয়েছে তখন তিনি ভীষণ হতাশ হয়েছিলেন।
মৌলানা আজাদ মনে করতেন, ভারত বিভক্ত হলে সেটি শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, পুরো ভারতের জন্যই সেটি খারাপ হবে।
তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের মূল সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। সাম্প্রদায়িক সমস্যা কোন বড় সমস্যা ছিল না।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহেরুকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মৌলানা আজাদ। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল এতোটাই অনড় ছিলেন যে তিনি অন্য কারো মতামত শুনতে মোটেই রাজি ছিলেন না।
সরদার প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মৌলানা আজাদ তাঁর বইতে লিখেছেন, ” আমরা পছন্দ করি কিংবা না করি, ভারতবর্ষে দুটো জাতি আছে। হিন্দু এবং মুসলমানরা একজাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। যখন দুই ভাই একসাথে থাকতে পারে না, তখন তারা আলাদা হয়ে যায়। তাদের পাওনা নিয়ে আলাদা হয়ে যাবার পরে তারা আবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যদি একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করবে।প্রতিদিন মারামারি করার চেয়ে একবার বড় ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো।”
মি: আজাদের বর্ণনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু এখন সরদার প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন।
ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল যেভাবে প্রকাশ্যে কথা বলতেন, জওহরলাল নেহেরু সেভাবে বলতেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী পরিষদে মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করতে গিয়ে মি: নেহেরুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। সেজন্য জওহরলাল নেহেরু মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন ভারতবর্ষ ভাগ না করে কোন উপায় নেই।
মি: নেহেরু মৌলানা আজাদকে অনুরোধ করলেন, তিনি যাতে ভারত ভাগের বিরোধিতা না করেন এবং বাস্তবতা মেনে নেন।
নেহেরু এবং সরদার প্যাটেলের এ অবস্থানের কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আরো জোরালো অবস্থান নিলেন।
জওহরলাল নেহেরুকে সতর্ক করে মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, ” আমরা যদি ভারত ভাগ করার বিষয়ে একমত হই তাহলে ইতিহাস কোনদিনও আমাদের ক্ষমা করবে না।”
সরদার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুকে বোঝাতে ব্যর্থ হবার পর মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী ছিলেন মৌলানা আজাদের শেষ ভরসা।
একদিন মৌলানা আজাদ মি: গান্ধীর সাথে দেখা করতে গেলে মি: গান্ধী বলেন, ” ভারত ভাগের বিষয়টি এখন বড় একটি ভয়ের কারণ হয়েছে। মনে হচ্ছে বল্লবভাই (সরদার প্যাটেল) এবং জওহরলাল আত্নসমর্পন করেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি আমার পাশে থাকবেন নাকি আপনিও মত পরিবর্তন করেছেন? কংগ্রেস যদি ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে সেটা আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে হতে হবে। আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন ভারতবর্ষ ভাগ মানব না।”
কয়েকদিন পরে মি: গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করলেন। এরপর সরদার প্যাটেল মি: গান্ধীর সাথে দেখা করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করলেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু জানা যায়নি। কিন্তু এরপর যখন মৌলানা আজাদ মি: গান্ধীর সাথে দেখা করলেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হলেন মৌলানা আজাদ।
কারণ ভারত ভাগ করার ফমূর্লা নিয়ে মি: গান্ধীর আগের অবস্থান বদলে গেছে। তিনি ভারত বিভক্তি সমর্থন না করলেও, আগের মতো জোরালো বিরোধিতাও করছেন না।
মি: গান্ধীর এ অবস্থান দেখে হতাশ হয়েছিলেন মৌলানা আজাদ। তবে মি: গান্ধী জানালেন, তিনি প্রস্তাব করেছেন যাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সরকার গঠন করে এবং তাঁর পছন্দ মতো ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা তৈরি করে। এ বিষয়টি মি: গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে তুলে ধরেন এবং মি: মাউন্টব্যাটেন তাতে রাজী হয়েছেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, মি: গান্ধীর প্রস্তাব যদি কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলে ভারত বিভক্তি এড়ানো যেতে পারে।
কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ও সরদার প্যাটেল মি: গান্ধীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা দুজনে মিলে মি: গান্ধীকে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।
তখন মি: গান্ধী বলেন, ভারতবর্ষ বিভক্তি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কিভাবে ভাগ হবে।
মৌলানা আজাদ রাজী না থাকলেও ভারত ভাগ করার বিষয়ে কংগ্রেসের বাকি নেতৃত্ব সেটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারপরেও মৌলানা আজাদ তাঁর শেষ চেষ্টা হিসেবে মি: গান্ধীকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি মি: গান্ধীকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে সেটি আরো দুই বছর চলুক। প্রকৃত ক্ষমতা এখন ভারতীয়দের হাতে। এ পরিস্থিতি যদি দুই বছর পর্যন্ত চলে তাহলে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এ সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থান বদলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতেও পারে।
মৌলানা আজাদ ভেবেছিলেন, দুই বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ একমত হতে বাধ্য হবে।
কিন্তু মি: গান্ধি এ প্রস্তাব বাতিল করলেন না এবং কোন আগ্রহও দেখালেন না।
এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে যান। মৌলানা আজাদ মনে করেন, মি: মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্ত করার পক্ষেই ছিলেন এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে গিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ৩০শে মে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ২রা জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন।
তার পরের দিন ৩রা জুন মি: মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত ‘হোয়াইট পেপার’ বা ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
ব্রিটিশ সরকারের সে ঘোষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষ অখণ্ড রাখার সব আশা শেষ হয়ে গেল।
মৌলানা আজাদ মনে করেন, ভারতবর্ষ ভাগ করার পেছনে ভারতীয়দের স্বার্থের চেয়ে ব্রিটিশদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত বিচার বিশ্লেষণ করে তারা ভারত ভাগ করার দিকেই এগিয়ে গেল।
ব্রিটেন মনে করেছিল, যদি অখণ্ড ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে সে দেশটির উপর তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে না।
বিভক্ত ভারতবর্ষ ব্রিটেনের স্বার্থ হাসিল করতো বলেই তাদের ধারণা।
মৌলানা আজাদ লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার স্বাধীনতার মূল্য দিতে হলো।
(ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি এবং কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বই থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।সে সময় তিনি কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফিরোজ বখত। কিন্তু যৌবনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন মুহিউদ্দিন আহমেদ নামে। পরবর্তীতে তিনি ছদ্মনাম ধারণ করেন আবুল কালাম আজাদ হিসেবে এবং সেটিই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে।)