নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশের উত্তরের অন্যতম প্রতিবেশী দেশ নেপালে জাতীয় সাধারণ ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর এটি দ্বিতীয় নির্বাচন।
মাওবাদীদের প্রায় ২০ বছরের সশস্ত্র তৎপরতা এবং রাজতন্ত্রের অবসানের পর ২০০৮ সালে নেপালের গণপরিষদে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতগুলো বছরের হানাহানির পরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেপালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কোনো সমস্যা বা সহিংসতা হয়নি।
সেই নির্বাচন ঘরে-বাইরে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নেপালের সব নির্বাচন একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে এবং দেশটির জনগণের কাছে বিনা আপত্তিতে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
সর্বশেষ নভেম্বর মাসে দুই পদ্ধতির নির্বাচন সম্পন্ন হলেও এখনো নতুন সরকার গঠিত হয়নি। তবে যে ধরনের ফলাফল হয়েছে, তাতে নিশ্চিত যে শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে নেপালি কংগ্রেস ও পাঁচদলীয় জোট সরকার গঠন করতে চলেছে। এই জোটের প্রধান আরেকটি দল পুষ্পকমল দাহালের (প্রচণ্ড) কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওয়িস্ট সেন্টার (সিপিএন-মাওয়িস্ট সেন্টার)। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে এখনো দুটি আসনের প্রয়োজন রয়েছে; এ জোটের মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, অচিরেই প্রয়োজনীয় আসন পেতে যাচ্ছে তারা।
সরকার গঠন নিয়ে তাদের নিরপেক্ষ বিজয়ী প্রার্থী ছাড়াও নতুন দল জনমত পার্টির সঙ্গে আলোচনা চলছে। জনমত পার্টি ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে একটি আসন পেয়েছে, তবে ভোটের সংখ্যা অনুপাতে তাদের ন্যূনতম আসন পাঁচটি।
নেপালের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা নিম্ন পরিষদের মোট আসনসংখ্যা ২৭৫। এর মধ্যে ১৬৫ আসনে এফপিটিপি পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষ ভোট হয়। ১১০টি আসন প্রপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এফপিটিপির জন্য সম্পূর্ণ দেশকে ১৬৫টি আসনে বণ্টন করা হলেও পিআর পদ্ধতি অনুসারে সমগ্র দেশটিকে একক আসন হিসেবে ধরা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে ছোট দলগুলোও যেমন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তেমনি নেপালের সংবিধানের ধারা মোতাবেক বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। একইভাবে পার্টির এবং সংসদে ৩৩ শতাংশ নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
নেপালের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর প্রভাব উপমহাদেশে জটিল ও সংকীর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কতখানি প্রভাব ফেলবে, তা হবে দেখার বিষয়; বিশেষ করে উপমহাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উভয় পদ্ধতির ফলাফল ঘোষণায় দেখা যাচ্ছে, দেউবার নেতৃত্বে নেপালি কংগ্রেস ৮৯ আসন পেয়ে একক সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর পরেই রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাগড়া প্রসাদ শর্মা অলির (কে পি শর্মা অলি) নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-ইউনাইটেড মার্কিন লেনিনিস্ট (সিপিএন-ইউএমএল) সর্বমোট ৭৮টি আসন এবং পুষ্পকমল দাহালের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওয়িস্ট সেন্টার (সিপিএন-মাওয়িস্ট সেন্টার) উভয় পদ্ধতিতে পেয়েছে মোট ৩২ আসন।
নেপালের এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। এর মধ্যে প্রধান দৃশ্যমান বিষয়টি হচ্ছে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান এবং তাঁদের প্রতি জনসমর্থন। প্রথমবারের মতো একজন অরাজনৈতিক তরুণ ব্যক্তিত্ব রবি লেমিচানের নেতৃত্বে নতুন দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি এফটিপিটি পদ্ধতিতে ৭টি এবং ১০ শতাংশ ভোট পাওয়ায় আনুপাতিক হারে আরও ১৩টি আসন পেয়ে মোট ২০টি আসন পেয়েছে। নেপালে রবি দারুণ জনপ্রিয় একজন সাবেক টেলিভিশন সঞ্চালক।
তাঁর দল রাজনীতিতে তরুণদের টানতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় দৃশ্যমান বিষয়টি হলো পরিবারতন্ত্রের ব্যাপক প্রত্যাখ্যান। উদাহরণস্বরূপ, পুষ্পকমল দাহালের পুত্রবধূ বিনা মগর, বাবুরাম ভট্টরায়ের মেয়ে মানসী ইয়ামি ভট্টরায়, মুসলমান রাজনীতিবিদ আফতাব আলমের ছেলে মোহাম্মদ ফিরদৌসসহ অনেক হেভিওয়েট নেতার আত্মীয়স্বজন পরাজিত হয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে বৃহত্তর কাঠমান্ডুতে নেপালের বাম দলগুলোর প্রভাব কমেছে। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে মাদেশি রাজনীতিতে পরিবর্তন দৃশ্যমান। এ নির্বাচনে নেপালে তিনটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ ছাড়া নেপালের বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে বেশির ভাগ দলের কথিত ইয়েসম্যান বা সোজা কথায় চাটুকারেরা।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নেপাল বর্তমান বিশ্বের নতুন ভূরাজনীতির একেবারে ঝড়ের কেন্দ্রে রয়েছে। নেপালের উত্তরে অভিন্ন সীমান্তে রয়েছে বিশ্বের নতুন উদীয়মান পরাশক্তি চীন এবং দক্ষিণে রয়েছে চীনবিরোধী এ অঞ্চলের উঠতি শক্তি ভারত। লক্ষণীয়, উপমহাদেশের দুটি (ভারত ও পাকিস্তান) এবং চীন—এ তিন পারমাণবিক শক্তিধারী রাষ্ট্র নেপালের তিন দিক ঘিরে রয়েছে। অন্যদিকে, নেপাল ঐতিহাসিক ও ভূবিন্যাসের কারণে ভারতের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল হলেও ইদানীং ভূরাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে একধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সরকারের সময় নেপালের বৈদেশিক নীতি অনেকটাই চীননির্ভর হয়ে পড়েছিল। ২০১৫-১৮ সময়ে তৃতীয়বারের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই সময়েই চীনের সঙ্গে শুধু বাণিজ্যই নয়, কৌশলগত উন্নয়নও শুরু হয়েছিল, যেটি এখনো চলমান। অন্যদিকে, ভারতের মাথাব্যথার কারণ নেপালে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং বিশাল অর্থনৈতিক লগ্নি ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থান। চীনের প্রস্তাবিত শিল্পপার্ক, যা দক্ষিণের সমতলে ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের জন্য একধরনের অস্বস্তির কারণ।
শুধু ভারতই নয়, নেপালের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও দেশটি গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট চীনের বিপক্ষ। ইতিমধ্যে দেউবা সরকারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ প্রস্তাব নেপালের সংসদে পাস করিয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নেপালকে কোয়াডে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টার অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে নেপাল-ভারতের সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে ওই সময়ের কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে ভারতের দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের মতে, এর সুযোগ নিয়েছিল চীন। কাজেই নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকার গঠনের সম্ভাবনা দিল্লির পররাষ্ট্র ও ভূরাজনীতিবিদদের স্বস্তির কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
নেপালের জনগণের বড় অংশের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভার রয়েছে। তবে সংবিধানের ধারামতে, ন্যূনতম দুই বছর দেউবার জোট সরকার ক্ষমতায় থাকবে। দিল্লির নেপালভিত্তিক কূটনীতির কেন্দ্রে থাকবে দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকারকে পূর্ণ মেয়াদের জন্য টিকিয়ে রাখা এবং ভূরাজনীতির কঠিন অঙ্কের সরলীকরণ করে নিজের পক্ষে রাখা।
নেপালের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর প্রভাব উপমহাদেশে জটিল ও সংকীর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কতখানি প্রভাব ফেলবে, তা হবে দেখার বিষয়; বিশেষ করে উপমহাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
- ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) [email protected]