today-is-a-good-day

নুসরাতের মাকে ‘হুমকি দেন’ ফেনীর এডিএম

নুসরাতের মাকে ‘হুমকি দেন’ ফেনীর এডিএম

ন্যায়বিচার পেতে ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম- রাজস্ব) পিকে এনামুল করিমের কাছে গিয়েছিলেন নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার। কিন্তু ন্যায়বিচারের পরিবর্তে সে সময় নুসরাতের বিরুদ্ধে ‘নাটক’ সাজানোর অভিযোগ করেন তিনি।

এ ছাড়া নুসরাতের মৃত্যুর আগে তার মা শিরিন আক্তারকে হুমকি দিয়ে এডিএম বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছেন, তা প্রমাণ করতে না পারলে আপনাদের বিরুদ্ধে প্রিন্সিপালের লোকজন ৫০ লাখ টাকার মানহানি মামলা করবে।’ জেলার সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন কথায় মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন নুসরাত।

শিরিন আক্তার আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষের কক্ষে আমার সামনে নুসরাত অজ্ঞান হয়ে গেলে তার মুখে পানি ছুড়ে মেরেছিলেন সোনাগাজী থানার এসআই ইকবাল।’ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার লোকজনের দেওয়া আগুনে পুড়ে নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর পর গত ১৮ এপ্রিল তার মা পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন।

জবানবন্দিতে শিরিন আক্তার বলেন, ‘৪ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে আমি, আমার মেয়ে রাফি, ছেলে নোমান, মাদ্রাসা কমিটির সভাপতিসহ ফেনী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পিকে এনামুল করিমের অফিসে গিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জানাতে চাই। তখন এডিএম বলেন, এখন কেন এসেছেন? আপনারা তো মামলা করে ফেলেছেন। মামলা করার আগে আসতেন, তা হলে দেখতাম কী করা যায়। এখন মামলায় যা হবে তা-ই হবে।

তখন রাফি এডিএমকে বলেন, আপনি আমার বাবার মতো। আপনি আমার কথাগুলো শোনেন। রাফি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগটি জানানোর চেষ্টা করেন এডিএমকে। তখন এডিএম বলেন, প্রিন্সিপাল তো খারাপ, তা সবাই জানে। তুমি তার কাছে গেছ কেন? উত্তরে রাফি বলেন, আমি তো ইচ্ছা করে যাইনি। পিয়নকে দিয়ে প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন। তখন এডিএম বলেন, গেছই যখন, তখন হজম করতে পারলে না কেন? তোমার বাবাকে মাদ্রাসায় বসানোর জন্য এ রকম নাটক সাজিয়েছ?’

এদিকে জবানবন্দিতে দেওয়া নুসরাতের মায়ের এসব তথ্য অস্বীকার করে এডিএম এনামুল করিম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছি! আমি এসব কিছু বলিনি। আমি তো মামলা করায় তাদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তারা যেন বিচার পান, সে কথা বলেছিলাম।’

এডিএম ছাড়াও নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার পক্ষ নিয়ে সোনাগাজী থানার এসআই ইকবাল হোসেনের কর্মকা-ের কথা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমি শিরিন আক্তার (৪৬)। স্বামী একেএম মুসা মানিক। গ্রাম চরচান্দিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ড, সোনাগাজী পৌরসভা। আমি গৃহিণী। নুসরাত রাফি আমার একমাত্র মেয়ে। তা ছাড়া আমার ৩ ছেলে আছে। রাফি তৃতীয় সন্তান।

৬ মাস আগে বেলা ৩টার দিকে রাফি মাদ্রাসা থেকে বাসায় ফিরে কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করলে জানায়, ওইদিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তাকে ক্লাসরুমে খুঁজতে গিয়ে পাননি। কিছুক্ষণ পর রাফি সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার পর অধ্যক্ষ তাকে দেখে কথা আছে বলে থামান। এ সময় রাফি অধ্যক্ষকে বলে, তার সঙ্গে কোনো কথা নেই। তখন সিরাজউদ্দৌলা রাফির ওড়না ধরে টান দেন। এ ঘটনায় রাফি কান্নাকাটি করে বলে আমাকে জানায়।’

‘কিছুদিন আগে আলিম টেস্ট পরীক্ষার সময় রাফিকে অধ্যক্ষ সিরাজ তার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে তার কথামতো কাজ করার প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে পরীক্ষার ফি দেওয়া লাগবে না বরং আরও টাকা দেওয়া হবে বলে জানান। অধ্যক্ষ ওইদিন রাফিকে বলেন, তুই তো অন্য ছেলেদের সঙ্গে কথা বলিস। আমার সঙ্গে কথা বললে সমস্যা কোথায়? প্রতিউত্তরে রাফি অধ্যক্ষকে বলে যে, আপনি হলেন আমার শিক্ষক, বাবার মতো। অন্য ছেলেদের সঙ্গে আপনার কি তুলনা হয়?

‘ওই ঘটনার পর গত ২৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে আমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাসায় ফেরার আগ মুহূর্তে আমার ছেলে নোমানের কাছে জানতে পারি, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এবার রাফির গায়ে হাত দিয়েছে। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ছোট ছেলে রায়হানকে নিয়ে সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসায় আসি এবং অধ্যক্ষের রুমে যাই। অধ্যক্ষকে তার রুমে পেয়ে আমি বলি, কোন সাহসে তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছ? এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যক্ষ আমাকে বলে, তুমি কোন সাহসে অফিসে ঢুকেছ? এটা অফিস রুম। তখন আমি বলি, এটা অফিস রুম নয়, এটা ব্যভিচারের রুম। তখন অধ্যক্ষ একজনকে ফোন দেন এবং কিছুক্ষন পর সোনাগাজী থানা থেকে এসআই ইকবাল আসেন। এসআই এসে জিজ্ঞেস করেন, এখানে কী হয়েছে? আমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে দেখিয়ে বলি যে, তাকে জিজ্ঞেস করেন। তখন আমাকে দেখিয়ে অধ্যক্ষ বলে যে, এরা আমার অফিসে এসে হামলা করছে নাটক সাজিয়ে।

শিরিন আক্তার আরও বলেন, আমি পুলিশকে বলি, ওনাকে জিজ্ঞেস করেন আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে কেন? এ কথা বলার পর অধ্যক্ষ হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে অন্যরকম ভান দেখান। এসআই ইকবাল ঘটনা শোনার পর রাফিকে মাদ্রাসায় আসতে বলেন। তখন আমি আমার ছেলে নোমানকে ফোন করে রাফিকে মাদ্রাসায় নিয়ে আসতে বলি। নোমান রাফিকে নিয়ে মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের রুমে এলে রাফি অধ্যক্ষকে দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়। তখন এসআই ইকবাল বলে যে, এই মেয়ে ঢং করো না, তোমার সঙ্গে এমন কিছু হয়নি যে বেহুঁশ হয়ে যেতে হবে। এগুলো আমরা জানি। এসআই ইকবাল ক্ষুব্ধ হয়ে রাফির মুখে পানি মারেন। এর পর রাফির একটু হুঁশ ফিরলেও সে কথা বলতে না পারায় এসআই ইকবাল রাফির বান্ধবী নিশাত ও ফূর্তিকে জিজ্ঞেসবাদ করেন।’

‘এসআই ইকবাল ও মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমিন বলেন যে, এগুলো এখানে হবে না। থানায় নিয়ে যেতে হবে। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে আমি আমার মেয়ে রাফি, ছেলে নোমান, রায়হান, রাফির বান্ধবী নিশাত, ফূর্তিসহ সোনাগাজী থানায় যাই।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, পিয়ন নুরুল আমিনও থানায় যান। থানার ওসি তার রুমে রাফি, নিশাত, ফূর্তিকে জিজ্ঞেসবাদ করেন। পরে আমি ওসির রুমে যাই এবং আমার সামনে পিয়ন নুরুল আমিনকে ওসি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওসি পিয়ন নুরুল আমিনকে জিজ্ঞেস করেন যে, রাফির সঙ্গে কোনো ছেলের সম্পর্ক ছিল কিনা। পিয়ন নুরুল আমিন না জানায়। ওসি তখন পিয়নকে বলে যে, তুমি কি রাফিকে অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নিয়েছিলে? নুরুল আমিন হ্যাঁ জবাব দেয়। এর পর রাফিকে ওসি তার রুমে একা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

থানার একজন অফিসার ওই ঘটনায় কম্পিউটারে এজাহার প্রস্তুত করে দিলে আমাকে ওই এজাহারে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি স্বাক্ষর করি। পরদিন ২৮ মার্চ পুলিশের কথামতো রাফিকে সঙ্গে নিয়ে সিএনজিযোগে আদালতে যাই। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট রাফির জবানবন্দি রেকর্ড করেন। কোর্টে যাওয়ার পথে দেখি যে, মাদ্রাসার শিক্ষকসহ অন্যরা মানববন্ধন করছে। এটা দেখে রাফি আফসোস করে বলে যে, বাবার মতো শ্রদ্ধা করা মাদ্রাসার শিক্ষক আফছার স্যার ও হারুন হুজুরকে ঘটনা জানিয়েছি। অথচ তারাও প্রিন্সিপালের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছে। এগুলো দেখে রাফি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোর্ট থেকে ফেরার পথে আমরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে আমাদের অনুরোধে এসআই ইকবাল আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন।’

‘৪ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে আমি আমার মেয়ে রাফি, ছেলে নোমানসহ মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি এবং ফেনী জেলার এডিএম পিকে এনামুল করিমের অফিসে গিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জানাতে চাই। তখন এডিএম রাফিকে নাটক করাসহ তার বিরুদ্ধে মামলা হবে বলে হুমকি দেন। রাফি প্রত্যুত্তরে এডিএমকে বলে, আমার বাবা এসবের কিছুই জানে না। তাই তাকে মাদ্রাসায় বসানোর প্রশ্নই আসে না। এডিএমের কথা শুনে রাফিসহ আমরা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি।’

‘৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে রাফি তার ভাই নোমানের সঙ্গে আলিম পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। রাফিকে পরীক্ষার হলে তুলে দিয়ে নোমান আমাকে ফোনে জানায়নি বলে চিন্তা করছিলাম। কারণ অন্যদিন নোমান ফোনে জানায়। ওইদিন সাড়ে দশটার দিকে নোমান ফোনে আমাকে জানায় যে, রাফির সঙ্গে কাপড়-চোপড় নেই। কাপড় নিয়ে আসেন। রাফির গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

রাফিকে ফেনী সদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে আমি ফেনী সদরে চলে যাই। ফেনী হাসপাতালে গিয়ে রাফিকে দেখি এবং রাফি তার গায়ে ওড়না দিতে বললে আমি ওড়না দিই। এর পর ফেনী সদর থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রাফিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। রাফি ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এসআই ইকবাল একবার গিয়েছিলেন।’