- গোলাম মাওলা রনি
- ০৪ জুন ২০২০
আগে আমার নিজের কিছু কথা বলে নেই। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সরকার যখন কথিত ছুটি ঘোষণা করল তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে, কী মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে। আমি ব্যবসাবাণিজ্য করছি তা প্রায় ৩০ বছর হতে চলল। প্রথম দিকে অন্য সব নতুন ব্যবসায়ীর মতো আমাকেও অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কিন্তু পারিবারিকভাবে সচ্ছল থাকার কারণে অর্থসঙ্কট অথবা দরিদ্রতার ভয় আমাকে কোনো দিন তাড়িত করেনি। পরে নিজের ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর মেহেরবানিতে যেমন পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি- অন্য দিকে ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় পড়তে হয়নি। কিন্তু করোনার কবলে পড়ে আমার মতো ব্যবসায়ীরা যে কী বিপদে পড়েছেন তা বোঝানোর জন্য নিজের কথা না বলে আমার এক ভাড়াটিয়া যিনি এ দেশের বেশ বড় একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী তার দুঃখের কাহিনী বললে সম্মানিত পাঠক পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারবেন।
সাভারে আমার একটি মাঝারি আকারের কম্পোজিট টেক্সটাইল রয়েছে, যেখানে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক চাকরি করেন। কারখানাটির কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের দিকে এবং তা চালাই ২০১৩ সাল অবধি। এরপর নিজের রাজনীতি এবং অন্যান্য কারণে আমার সেই কারখানাটি ১০ বছরের জন্য লিজ দিলাম দেশের একটি নামকরা গার্মেন্টস শিল্প গ্রুপের কাছে। তারা গত সাত বছর ধরে চমৎকারভাবে ফ্যাক্টরিটি চালাচ্ছিলেন এবং তাদের অন্যান্য ব্যবসাও বেশ ভালোভাবে চলছিল। তাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার লোক চাকরি করে এবং মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করতে হয়। করোনার ধাক্কায় তাদের ২০০ কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে এবং আরো প্রায় ১০০ কোটি টাকার পণ্যের বিল সংশ্লিষ্ট ক্রেতারা মালামাল পৌঁছার পরও আটকে দেন। কেউ কেউ টাকা পরিশোধের আইনি বাধা এড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে গিয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন।
আমাদের দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে যে মূলধন বিনিয়োগ করা হয়, সেখানে বহুপক্ষের অংশগ্রহণ থাকে। যেমন ধরুন, আমার ১০০ কোটি টাকার সমমূল্যের একটি কারখানা রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় আমি নিজের টাকা দিয়ে জমি কিনেছি এবং আশিংকভাবে ভবনের কাজ করে কোনো ব্যাংকের কাছে লোনের জন্য দরখাস্ত করেছি। তারপর বাংলাদেশের ডাল-ভাত, আলো-বাতাস এবং প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেছি। এরপর বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে মেশিনপত্র সংগ্রহ করেছি। এরপর বিদেশী বায়ারের কাছ থেকে এলসি পাওয়ার পর ব্যাংকের মাধ্যমে বাকিতে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করেছি। এ ক্ষেত্রে পুরো প্রজেক্টের মূল্য যদি ১০০ কোটি টাকা হয়, তাহলে যিনি উদ্যোক্তা তিনি হয়তো সাকুল্যে পাঁচ-দশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। বাকি টাকা ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মেশিন সাপ্লাইয়ার প্রমুখদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
উপরোক্ত ১০০ কোটি টাকার ফ্যাক্টরিতে হয়তো বছরে ৫০০ কোটি টাকার রফতানি হয়, যা মূলত কারখানা মালিকের ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানি সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসার যে ধরন, তাতে কোনো কোম্পানি যদি সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করে, তবে সর্বোচ্চ শতকরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লাভ করা সম্ভব। সেখান থেকে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন, ট্যাক্স, ভ্যাট, বিদ্যুৎ, ফ্যাক্টরি ভাড়া ইত্যাদি পরিশোধ করার পর একজন মালিকের নিট লাভ থাকে সর্বোচ্চ শতকরা ৫ শতাংশ- যা দিয়ে তাকে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে হয় এবং নিজেও চলতে হয়। ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প যদি টানা ২৫-৩০ বছর লাভ করতে পারে তখনই কেবল ব্যাংকের দায়-দেনা শোধ করা সম্ভব। ৩০ বছর পরে দেখা যায়, ১০০ কোটি টাকা দিয়ে যে প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল সেই প্রকল্পের বিল্ডিংয়ের দাম কমেছে ৫০ শতাংশ, মেশিনের দাম কমেছে ৯০ শতাংশ এবং ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করা হয়েছে মূলধনের তিন থেকে চার গুণ। আর যদি মাঝখানে বড় কোনো লোকসান বা দুর্ঘটনা ঘটে তবে মালিকপক্ষ, ব্যাংক, মেশিন সাপ্লাইয়ারসহ সবাই বিপদে পড়ে যান।
বাংলাদেশের যত বড় বড় গার্মেন্টস, স্পিনিং মিল এবং অন্যান্য বৃহৎ কলখারখানা দেখতে পান তা মোটামুটি এভাবে চলে। সেই হিসাবে আমার ভাড়াটিয়া কিভাবে চলেছেন এবং আমি কিভাবে ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম তা যেমন বুঝতে পারছেন, তেমনি প্রতি মাসের ভাড়ার টাকা নিয়ে কিভাবে ব্যাংক লোন পরিশোধ করছি, তাও হয়তো অনুমান করতে পারছেন। এ অবস্থায় আমার ভাড়াটিয়া ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাসহ প্রায় ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করলেন বটে- কিন্তু আমার ভাড়া দিতে গড়িমসি শুরু করলেন এই কারণে যে, তিনি আমার সাথে করা চুক্তি থেকে বের হওয়ার জন্য সর্বতো চেষ্টা-তদবির শুরু করেছেন। আমার উপরোক্ত ব্যাংকের চাপ এবং অন্যান্য পাওনাদারের চাপের সাথে ভীতি যুক্ত হয়ে পুরো পরিস্থিতি এতটা বীভৎস হয়ে উঠল যে, গত টানা ১০-১২ বছর ধরে নয়া দিগন্তে যে উপসম্পাদকীয় লিখছি তা বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। টকশো-সেমিনার, সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদি সব কিছু বন্ধ করে নামাজ-কালাম এবং কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে মাবুদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মানসিক প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করতে থাকি।
এমন অবস্থার মধ্যেই নুরুন আমাকে ফোন দিলো। ওর কথা শুনে মনটা আমার বিষণ্নতায় ভারী হয়ে উঠল। কারণ নুরুন নাহারকে চিনি সেই ১৯৯৮ সাল থেকে, যখন তার বয়স বড় জোর ছিল ৮-৯ বছর। গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী কালো কুচকুচে মেয়েটি যে দিন আমাদের বাসায় এলো তখন আমার স্ত্রী রীতিমতো প্রমাদ গুনলেন। হাড় জিরজিরে লিকলিকে চেহারা, উসকো-খুশকো চুল দেখে বোঝা যায়, ওর মাথায় হাজার হাজার উকুন দিন-রাত শোষণ করে ওকে রক্তশূন্য হাড্ডিসার বানিয়ে ফেলেছে। তার ওপর খোসপাঁচড়া এবং অপরিচ্ছন্ন ছিন্ন পোশাকের কারণে ওকে এমন দেখাচ্ছিল, যা কিনা শহরের ধনিক শ্রেণীর বাসাবাড়িতে বেমানান। যে লোকটি নুরুন নাহারকে নিয়ে এসেছিল তাকে কিছু টাকা দিয়ে যখন তাকে গ্রামে ফেরত পাঠানোর কথা হচ্ছিল, ঠিক তখন আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। নুরুন নাহারের উদাসী চোখ দেখে আমার অন্তরটা কেঁদে উঠল। বলতে গেলে- জোর করেই নুরুন নাহারকে রেখে দিলাম।
মেয়েটি আমাদের বাসায় ছিল প্রায় চার বছর। খুব স্নেহ করতাম। সেও আমাকে এমনভাবে শ্রদ্ধা করত, যা দেখে মনে হতো কৃতজ্ঞতায় সে হয়তো মরে যেতেও রাজি। এরই মধ্যে নুরুন নাহার একবার গ্রামে গেল এবং তার মামা জোর করে মাত্র ১৩ বছর বয়সী নুরুন নাহারকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এর পর থেকে নুরুন নাহারের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ২০০৯ সালে যখন সংসদ সদস্য হলাম তখন নুরুন নাহার তার স্বামী, দুই শিশু সন্তান এবং তার মাকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলো। তাকে চিনতে পারছিলাম না। কারণ সে অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছিল এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তাকে অসুস্থ ও বয়স্ক মনে হচ্ছিল। সে পরিচয় দেয়ার পর আমি যখন তার সাথে সেই আগের মতো স্নেহের সুরে কথা বললাম, তখন সে বাকরুদ্ধ হয়ে মাথা নিচু করে অঝোরে অশ্রুপাত শুরু করল। তার স্বামী ও মা তাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে গেলেন। সেই যে নুরুন নাহার গেল আর কোনো দিন এলো না, ফোনও করল না। তার স্বামী মাঝে মধ্যে আসত বা ফোন করত এবং সাধ্যমতো অভাবী পরিবারটিকে সহযোগিতা করতাম।
দরিদ্র নুরুন নাহারকে আশ্রয় দেয়ার কারণে সে ছিল যারপরনাই কৃতজ্ঞ। বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ বিয়ে, দরিদ্রতা ও অসুস্থতার কারণে সে ছিল লজ্জিত। আবার আমার কাছ থেকে অভাবিত সম্মান ও স্নেহ পাওয়ার পর আবেগ আপ্লুত নুরুন নাহারের আত্মমর্যাদা প্রবল হয়ে উঠেছিল। ফলে সে অশ্রু বিসর্জন করে আমার কাছে তার অভাব প্রকাশের চেষ্টা করছিল। কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না। যখন তার স্বামীকে টুকটাক সাহায্য করা শুরু করলাম, তখন তার লজ্জাবোধ আরো প্রবল হলো। ফলে সে আর কোনো দিন আমার সামনে আসেনি বা ফোন করে কিছু চায়নি। সেই নুরুন নাহার এই করোনাকালে হঠাৎ করে ফোন করে জানাল যে, তিন তিনটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে গত দু’দিন ধরে অভুক্ত রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের কান্নায় স্থির থাকতে না পেরে সে বাধ্য হয়ে আমাকে ফোন করেছে।
তার স্বামী ফোন করতে সাহস পায়নি এ কারণে যে, কয়েক মাস আগে সে রিকশা কেনার নাম করে টাকা নিয়ে রিকশা না কিনে সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে এসেছে এবং তা শুনলে আমি হয়তো রাগ করতে পারি। ঢাকা এসে স্বামী মুটের কাজ করত এবং নুরুন নাহার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ছুটা বুয়া অর্থাৎ ঝিয়ের কাজ করত। করোনা সঙ্কটের কারণে তারা উভয়ে বেকার। কারো কাছ থেকে একমুঠো ভাত জোগাড় করতে না পেরে সন্তানদের আর্তচিৎকারে বাধ্য হয়ে, আত্মমর্যাদা ও সীমাহীন লজ্জার বাঁধ অতিক্রম করে আমার কাছে সাহায্য চাওয়ার অন্তরালে কতটা অমানবিক পরিস্থিতি যে তাড়া করেছে, সে কথা চিন্তা করে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
পরের ঘটনাটি চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর, যিনি গত দুই দশক ধরে অত্যন্ত সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে করতে পুরো গার্মেন্টস সেক্টরের মালিক-শ্রমিক-ক্রেতা-ব্যাংকার ইত্যাদি সব পক্ষের কাছে রীতিমতো আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোক করোনা সঙ্কটে পড়ে রোজার মাসে যখন শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে অঝোরে কাঁদছিলেন এবং তার সেই ক্রন্দনরত ছবি যখন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হলো, তখন করোনার আতঙ্ক দশ গুণ শক্তিশালী হয়ে রাক্ষুসের মতো আমাকে আক্রমণ শুরু করে দিলো।
করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে মহামারী শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশে এটি যেভাবে আঘাত হেনেছে তা মানুষজনকে কিভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে তার লক্ষ-কোটি ভাগের একভাগ দৃশ্যও হয়তো ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এই মহামারী আমাদের শরীর-মন-মস্তিষ্কতে এমনভাবে আক্রমণ করেছে যে, আমাদের জীবনকালের বাকি দিনগুলো যেমন আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখবে তেমনি মানবদেহের ডিএনএ কালচারের কারণে করোনাভীতি কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে তাড়া করে ফিরবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য