পঞ্চতন্ত্রের পাঁচটি নীতিকথা হলো, ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, মানীকে মান্য করা, গুরুজনের সেবা করা, আর ধর্মে অবিচল ভক্তি রাখাই মানুষের কর্তব্য।’ এই নীতিকথার অন্যতম দু’টি কম্পোনেন্ট হলো, ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’। ‘দুষ্ট’ শব্দের অর্থ আমরা জানি কারণ দুষ্টতেই তো ভরে গেছে দেশটি। তবে ‘শিষ্ট’ হলো একটি বিশেষণ পদ যার অর্থ শান্ত, রুচিবান, পরিশীলিত, শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গার্নার বলেন, রাষ্ট্র হলো কম বা বেশি এমন একটি জনসমাজ, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাইরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে, যার প্রতি অধিকাংশ অধিবাসীই আনুগত্য পোষণ করে। এই রাষ্ট্রের সফলতার অন্যতম নিয়ামক হলো দুষ্টকে দমন করে শিষ্টকে পালন করে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ করা। উন্নত বিশ্বে এই নীতি এখনো অনেকটা চর্চায় থাকলেও অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই নীতিকথার চর্চা তো হচ্ছেই না বরং হচ্ছে তার উল্টো। উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রচলন নিয়ে আজকের লেখা।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ৭৫ বছর পূর্বে ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হওয়া উপমহাদেশের তিনটি দেশের নানা রকম সমস্যা থাকলেও একটি সাধারণ সমস্যা হলো, এ অঞ্চলে রাজনৈতিক চিন্তাধারার দমন হয়েছে এবং ক্রমেই তা বাড়ছে। তার মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বহুপক্ষীয় মতাদর্শে বাংলাদেশ পূর্বে অনেক উন্নতি করলেও গত কত বছরে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। দেশের ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটর, যেমন- রিজার্ভ কমে যাচ্ছে; অস্বাভাবিক ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যাপকভাবে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, টাকার মান কমে যাচ্ছে ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতি অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে।
দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন যেভাবে
দুষ্টরা একটি অপরাধ করে পার পেলে দ্বিতীয় অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এভাবে ব্যক্তি নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় অপরাধ চক্র গড়ে তুলতে পারে। অপরাধী বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়। অনেক সময় দেখা যায়, এরা ক্ষমতাবান ও সম্পদশালীদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে। রাজনীতির সাথে অপরাধের যোগসাজশে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এরা। অপরাধী এবং তাকে রক্ষাকারী সমান অপরাধী। মন্ত্রী-এমপিরাও অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করেন।
দেশের সংসদ সদস্যদের মূল কাজ আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। কিন্তু তারা এলাকার শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশদের কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। নিজের মতের অনুসারীদের সুবিধা দেন, ভিন্নমতের অনুসারীদের দমন করেন। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের ধরতে চাইলেও সংসদ সদস্যের সুপারিশে ছাড়া পেয়ে যায়। বিরোধী মত দমন করে নিজ দলের কর্মীদের রক্ষা করাই যেন তাদের কাজ; ন্যায়-অন্যায় এখানে মুখ্য বিষয় নয়।
দেশের প্রায় সব দুর্নীতি ও অনিয়মই এবং অনাকাক্সিক্ষত কাজের সাথে ক্ষমতাবানদের সাথে সংশ্লিষ্টরা জড়িত। মাঝে মধ্যে তাদের দু’য়েক জন গ্রেফতার হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা আইওয়াশ। দুর্নীতির সাথে কেবল দুর্নীতিবাজ নয় বরং ক্ষমতাসীনদের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। অথচ তা কমই আমলে নেয়া হয়।
নীতিই যেখানে প্রণীত হয় দুর্নীতির স্বার্থে
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় শাসন চালু করায় দেশে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সুশাসনের ঘাটতির ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা এবং আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় পৌঁছেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের উচ্চাকাক্সক্ষী এবং বেহিসাবি ব্যয়ের সংস্কৃতি। বৈশ্বিক মানদণ্ডে দেশের প্রকল্প ব্যয় অত্যধিক বেশি। এসব প্রকল্পে দুর্নীতির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাত, যেমন- টাকার মান কমে যাওয়া এবং ডলার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ঋণের বোঝা আরো ভারী হয়ে উঠছে। শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বিশাল আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। এই সঙ্কটের বেশির ভাগই দুষ্টদের অব্যবস্থা।
ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি ইত্যাদি সবই যেন দুষ্টের দখলে। দুষ্টরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সবকিছুতেই রয়েছে নীতিনির্ধারকদের আশীর্বাদ। এক দিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্য দিকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনমান ভয়াবহ সঙ্কটে। সারা বিশ্ব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও এদেশ পারছে না। এর কারণ গোষ্ঠীস্বার্থ এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার অনুপস্থিতি। দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা, পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা, শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রায় আমরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। শিক্ষাব্যবস্থা তো নিয়ম করেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ধ্বংস করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান দুষ্টের দখলে। যে সরকার ক্ষমতায় আসুক তাদের ভিন্নমতের মেধাবীরাও চাকরি পায় না; এমনকি যারা ইতোমধ্যে কর্মে রয়েছে তাদেরও অনেককে বিতাড়ন অথবা ওএসডি করে দুষ্ট স্বজনদের সুবিধা দেয়া এখন রাষ্ট্রীয় নীতি। ফলে সকল সেক্টরে কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে।
সবচেয়ে কঠিন অথচ সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে দেশের নীতি প্রণয়নই করা হয় যেন দুর্নীতির স্বার্থে। যেমন ব্যাংকের আইন করা হচ্ছে গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো যেন তৈরিই হয়েছে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় লুটপাট করার জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে তো পারেই না বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই রিজার্ভ পাচার হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে। অভিযোগ আছে সরকারের ঘনিষ্ঠরাই শেয়ারবাজার লুট করেছে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে গত এক দশকে মেগা প্রজেক্ট নিয়ে বেহিসাবি ও উচ্চমাত্রার দেশের অর্থের অপচয় এবং তছরুপ করেছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ও মনিটরিং এবং বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ হচ্ছে। এই ব্যয় ঋণনির্ভর এবং সুদের হারও উচ্চ। এই সব প্রকল্প প্রণয়নই করা হচ্ছে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে। ঋণের বোঝা অব্যাহতভাবে বাড়ছে এবং ঋণ পরিশোধের সময় এগিয়ে আসছে।
সব পরিসংখ্যানই দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রকাশ করছে। এভাবে অর্থনীতি পরিচালনা অব্যাহত থাকলে তা চরমভাবে মানুষের স্বার্থকে হরণ করবে। এই সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, শাসকদের বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে এখন যে অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে তাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিষ্ঠান ও ফোরামগুলোর শানশওকত বাড়ছে। কিন্তু নীতি পরিচালনায় তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। অর্থনীতি পরিচালনায় ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছার অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। কারণ কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ও গোষ্ঠীস্বার্থ অনেকটা একাকার হয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছরেও দেশ গণতন্ত্রের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যায়নি। প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের অর্থনীতি দক্ষতার সাথে পরিচালনার গ্যারান্টি নেই। মানুষের ভোটের অধিকার অনেক আগেই হরণ হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে এখন গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় না থেকে ভিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় রকমের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক সময় নানা ধরনের দুর্যোগ অতিক্রম করে দেশ এগিয়েছে বিধায় বিশ্বে এ দেশের প্রতি সহানুভূতি ছিল। এই অর্জনের কৃতিত্বের দাবিদার ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি দেশের প্রতি বিশ্বের সেই সহানুভূতির জায়গায় পরিবর্তন আসছে। দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে তারা বিরক্ত। বিদেশীরা চায় গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসুক। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করুক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দেশ এগোতে পারে না।
দেশের রাজনীতি কলুষিত হওয়ার ফল ইতোমধ্যে মানুষ ভোগ করতে শুরু করছে। মেধাবী তরুণরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর একমাত্র সমাধান রাজনৈতিক নবায়নের মধ্যে। দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ভূরাজনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিধায় দেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এত সরব। দেশের মানুষও চিন্তিত। ক্ষমতাসীনদেরও এই নিয়ে ভাবতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
নয়াদিগন্ত