নির্বাচন : মিরাকল কিছু কি ঘটবে?

সালাহ উদ্দিন বাবর:   দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুসারে নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। এ নির্বাচনের জন্য বাজেটও নির্ধারণ করা হয়েছে যা কি না এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। এ যাবতকালের এটিই হবে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচনী বাজেট। অথচ আমরা জানি, এখন রাজনীতিতে ভোটের যে বাজার, সেখানে দেখছি কেবল শাসক দলের উপস্থিতি। অথচ নেই তাদের কোনো প্রতিপক্ষ। প্রধান প্রতিপক্ষকে রাখা হয়েছে কারান্তরালে। এই পরিবেশে নির্বাচন এবং নির্বাচনের ব্যয়টা কি অর্থপূর্ণ হবে? আমাদের সব কিছু নিয়ে ভাবা উচিত।

যাক, তার পরও আসন্ন ‘ভোটে’র সময় একমাত্র ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কোনো দল তাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না পায়। এর ফল হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আর হচ্ছে না। তারপরও যদি নির্বাচন করাই হয়, তবে সে নির্বাচন হবে অর্থহীন। আর নির্বাচনে যে অর্থ ব্যয় হতে পারে, তাকে অপচয় হিসেবে ধরে নিতে হবে। আর বর্তমান দেশের অর্থনীতির আলোকে তা করা কি ঠিক হবে? তার পরও মনে রাখতে হবে, সম্মুখে যদি কোনো মিরাকল ঘটে তবে হবে ভিন্ন বিবেচনা। আবার এমন ‘মিরাকল’ও ঘটতে পারে যে, স্টেশন মাস্টার যদি নির্বাচনী ট্রেনকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য সবুজ পতাকা উত্তোলন না করেন তবে সে রেলগাড়ি কি আর যাত্রা শুরু করতে পারবে! সে ট্রেনের যাত্রীরা তখন চরম দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়তে পারেন।

এদিকে, শোনা গেছে- আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে ‘পোটেনশিয়াল’ কোনো কোনো দলকে নির্বাচনী ট্রেনে তুলে দেয়ার লক্ষ্যে ওই দলগুলোর ওপর কর্তৃপক্ষের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। যাই হোক, এক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, সেখানে ভোটকেন্দ্রে নয়, জনগণ অতিথি হিসেবে গ্যালারিতে বসে বিষণ্ণ মনে ভোটের ‘খেলা’ দেখবেন।
সরকারি দলের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে কিন্তু নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করেছে। তা শুধু অভূতপূর্ব নয়। দেশের মানুষ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব তা শুনে স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ। দেশের প্রতিটি মানুষ একতরফা এই ঘোষণাকে তাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ বলে মনে করছেন। আগামীতে নির্বাচনসংক্রান্ত এসব নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন যদি হন, তবে জবাবটা কী?

এমন একটি ভবিষ্যৎহীন ও অনিশ্চিত নির্বাচনের জন্য শাসক দল কেবল পেরেশানই ছিল না, ‘বিজয়ী’ হওয়ার জন্য নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছু নিজেদের অনুকূলে বিন্যস্ত করে নেয়ার কৌশল এঁটেছে। অনেক দিন ধরে এই পরিকল্পনামাফিক সেটি নিয়ে তারা অগ্রসর হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে এমন দৃষ্টান্ত কি কোথাও কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে? এমন নির্বাচন অবশ্যই কোনো দেশের কল্যাণ আনতে পারে না।

ক্ষমতাসীন শক্তি নিজেদের সব দিক থেকে বিন্যস্ত করছে বলে যে কথা বলা হয়েছে, সেটি একটু খোলাসা করা যেতে পারে। দেখা যাক, রাজনৈতিক অঙ্গনের বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা কিভাবে বিন্যস্ত করে নিচ্ছে। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষসহ এবং তাদের সাথে চলমান আন্দোলনের সহযোগীদের কী নির্মমভাবে মেরেপিটে খড়কুটোর মতো ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরসহ অন্য দলের বহু নেতাকর্মী ও সমর্থক, যাদের সংখ্যা অগণিত তাদের বিরুদ্ধে ৫০ লাখের মতো মামলা সাজানো হয়েছে, যা গায়েবি মামলা বলে অবহিত হয়ে থাকে। বিএনপিসহ এই আন্দোলনে শরিক আরো অনেক দলের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে যাতে তাদের একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথটি নিষ্কণ্টক ও মসৃণ হয়ে যায়। এসব পদক্ষেপ নিতে সরকার-রাষ্ট্রশক্তিকে দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটি ‘সুসম্পন্ন’ করেছে বিন্যস্ত পুলিশ। এজন্য ক্ষমতাসীনরা তৃপ্তি, সুখবোধ, গর্ব, অহমিকায় ফুলেফেঁপে রয়েছে। তবে আখেরে তারা যে অপরিণামদর্শী হিসেবে সমালোচিত হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। আরো আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের সব পদক্ষেপ ‘হিটব্যাক’ও করতে পারে। তীব্র সমালোচনা, হেনস্তাসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হয়তো তারা ভুগবে। ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।

তথা বিন্যাস করা আর অবিন্যস্ত করে দেয়া। এই দুই শব্দের প্রথমটি ইতিবাচক আর দ্বিতীয়টি নেতিবাচক। কেউ যদি সেই ইতিবাচকতা কেবল নিজের জন্য বেছে নেয় আর নেতিবাচকতা অপরের দিকে ঠেলে দেয়! যারা নেতিবাচকতাকে অপরের দিকে ঠেলে দেবে আখেরে তাদের উপযুক্ত পুরস্কার হচ্ছে নিন্দা, সমালোচনা ও ধিক্কার। এ কথাগুলো এ জন্য মনে উঁকি দিলো; দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট বর্তমান অস্থিরতা অনুভব করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতার মুষ্টিটা আরো কত মজবুত ও স্থায়ী করতে ক্ষমতার সব ভরকেন্দ্রগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে বিন্যস্ত করে নিয়েছে। পক্ষান্তরে তাদের প্রতিপক্ষীয়দের ওপর নানা পথ ও পন্থা অনুসরণ করে অবিন্যস্ত করে তুলছে। খুব স্বাভাবিক ও সহজভাবে সেটি করা হচ্ছে যার নিদর্শন গত ২৮ অক্টোবর দেখা গেছে।

গত ২৮ অক্টোবর মানুষ দেখেছে, কী ‘চমৎকার’ভাবে সরকার তার অনুগত বিভিন্ন বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের শান্ত-সুশৃঙ্খল একটি সমাবেশকে কত না সক্ষমতার সাথে ভণ্ডুল করে দেয়। নিরস্ত্র বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনী কত নির্মমভাবে চড়াও হয়েছিল। দেশবাসী ও বিশ্বের সভ্য সমাজ সেটি দেখে হতভম্ব-হতবাক।

সরকার আর যা কিছু বিন্যাস করেছে সে কাতারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নামটি উপরেই আছে। বহুদিন থেকেই কমিশনে সকাল-বিকাল তাদের কথাবার্তা, বক্তব্য বিবৃতি ও ঘোষণার কোনো শেষ ছিল না। মানুষকে নিছক বিভ্রান্ত করে তাদের সত্যিকার কথা, তারা সত্যটি বলেছে ১৫ নভেম্বর। তবে দেশের সব স্তর ও শ্রেণিপেশার মানুষ সহজেই কমিশনের মন-মানস ‘রিড’ করতে পারছে কমিশনে অতীতের ভাব-ভঙ্গিকে স্মরণ করে। তারপর ইসি ইতোমধ্যে নতুন এক ‘ফরমান’ জারি করেছে। তারা জানিয়েছে, জানুয়ারি ’২৪ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য ‘পথকষ্ট’কে লাঘব করার জন্য যে কেউ ঘরে বসেই অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার অপার সুযোগ লাভ করবেন।

সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের সময় যারা ‘দায়িত্ব’ পালন করবে, তাদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের সম্মানী দ্বিগুণ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচন নিয়ে যত কুয়াশা, সে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের বহু ব্যত্যয় রয়েছে। তার একটি হচ্ছে- ক্ষুধা দারিদ্র্য আর তারা ভোটটা কোন পাত্রে দেবে? কোনো বিকল্প আর আছে? যে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য নির্ধারণ আছে, সেখানে আর ভোটারের কোনো লক্ষ্য থাকতে পারে না।

নির্বাচনের আগে সরকার আর ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে প্রয়াসী নয়। তারা গণপ্রশাসন, পুলিশসহ যেসব সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন তাদের মন জয় করতে চান। তার উদাহরণ। একটি জাতীয় দৈনিকের সাম্প্রতিককালে এ ধরনের একটি খবর প্রকাশ পেয়েছে, সে খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘পদোন্নতির উৎসব ভোটের আগে’।

সেখানে উল্লেখ রয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছে। এর সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশ উপরে। লক্ষণীয়, পদোন্নতি দেয়া হয়েছে কেবল কর্মকর্তাদের; যারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কর্মচারীদের কোনো পদোন্নতি নয়। কেননা, তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো জাদু দেখাতে পারবে না। জাদু দেখাতে কর্মকর্তারাই সক্ষম। আর কেউ নয়তো নয়। এমন নির্বাচন হলেই কী আর না হলেই কী? এর সাথে গণমানুষের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে নেই মানুষের ভোট আর ভাতের নিশ্চয়তা। একসময় তো এসব ছিল। এখন কেবল তারই স্মৃতিচারণ করা। এ নির্বাচনের লক্ষ্য, নিছক ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের ক্ষমতার উষ্ণ পরশ উপভোগ করা মাত্র। তাদের সেই সুখ ভোগের মেয়াদটা আরো বাড়িয়ে দেয়ার নিমিত্ত মাত্র।

নয়াদিগন্ত