বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার একটি আসনের উপ-নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে ভোটগ্রহণ বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সকাল থেকে শুরু হওয়া এই নির্বাচনে অনিয়মের কারণে একের পর এক কেন্দ্রে ভোট বাতিল করা হয়।
একপর্যায়ে দেখা যায় যতগুলো ভোটকেন্দ্র আছে সেখানে তার এক তৃতীয়াংশ কেন্দ্রেই ভোট বাতিল করতে হয়েছে।
এসব ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয়ার গোপন কক্ষে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অনেক জায়গাতেই একজনের ভোট আরেকজন দেয়ার অভিযোগ আছে।
বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক আপত্তি সত্বেও আগামী নির্বাচন ইভিএমে করার ব্যাপারেই এখন পর্যন্ত অনড় আছে কমিশন।
গাইবান্ধা-৫ আসনের বুধবারের ভোটগ্রহণও ইভিএমেই হচ্ছিল। কিন্তু তারপরও অনিয়মের অভিযোগে সেই ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিতে হল।
বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা বেশ অনেক বছর ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু নিকট অতীতে অনিয়মের কারণে দেশটিতে কোন নির্বাচন বাতিল কার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেশটির কোন নির্বাচন কমিশনকে দেখা যায়নি।
বুধবারের নির্বাচন বন্ধ করা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “নির্বাচনে অনিয়ম হচ্ছিল আমরা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছি”।
“কাদের কারণে ভোটটা বন্ধটা বন্ধ করতে হল সে ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি, এটা এখন বলা যাবে না , এটা আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে” সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তের বলেন মি. আউয়াল।
এর আগে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া বাকি চারজন প্রার্থী একযোগে এই নির্বাচন বর্জন করেছেন। এই নির্বাচনে অবশ্য বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধী দল অংশ নেয়নি।
গাইবান্ধায় যা ঘটেছে
সকাল ৮টায় সাঘাটা উপজেলার ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলার ৫৭টিসহ ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোট শুরু হয়।
এবারই প্রথম ইলেকট্রোনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে আসনটিতে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা।
এক হাজার ২৪২টি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আছে সব ভোটকেন্দ্র।
সেখানে অনিয়মের ঘটনা দেখার পর বেলা ১২টা পর্যন্ত কয়েক দফায় মোট ৪৪টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে বলে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা দেখেছেন, কেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যারা অনিয়ম করেছে তারা ভোট ডাকাত, দুর্বৃত্ত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।
যারা এসব করেছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে বা নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী হবে এমন প্রশ্ন করা হলে সিইসি বলেন, কমিশন বসে সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এই বক্তব্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই অবশ্য কমিশন ভোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
আসনটিতে ৫জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন।
তারা হলেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মাহমুদ হাসান রিপন, জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু (লাঙল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)।
এদের মধ্যে মাহমুদ হাসান রিপন ছাড়া সবাই ভোট বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
গত ২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া। এর দুই দিন পর তার সংসদীয় আসন গাইবান্ধা-৫ শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়।
যেভাবে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে
গাইবান্ধার ফুলছড়ির একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন তার কেন্দ্রে তেইশশো ভোটার রয়েছে।
কিন্তু দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ৫৪০টা ভোট গ্রহণ হয়েছে।
তিনি বলেন, সকাল ১০টার পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন, তাদের সঙ্গে পুলিশ ছিল।
তারা এসে অন্যান্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেন।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি এমন যে এখানে একটা পেশীশক্তি কাজ করছে। আমাদের করার কিছুই থাকছে না।
জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু বিবিসিকে বলেন, নির্বাচনের আগেই পরিবেশটা কয়েক দিন থেকে লক্ষ্য করেছেন, দেখেছেন তাদের পোষ্টার, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে।
তিনি বলেন “আমরা নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি, তারা আশ্বস্ত করেছে এরপর নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি একেবারেই প্রতিকূল”।
মি. রনজু বলেন “আজকে সকাল ৬টা থেকে আমাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, তাদের ধাওয়া দেয়া হচ্ছে, আওয়ামী লীগের এজেন্টরা ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ নিচ্ছে, যখন ইভিএমে মার্কা আসছে তখন তারা (এজেন্টরা) নৌকা মার্কায় ভোট দিচ্ছে। কোন শৃঙ্খলা নেই, এটাকে কোন নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। ইলেকশন কমিশন পুরাপুরি ব্যর্থ। তাই আমরা এই নির্বাচন বর্জন করেছি”।
এদিকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।
জাতীয় নির্বাচনের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি মাত্র আসনে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন করতে না পারাটা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, প্রথমত ইলেকশন কমিশন একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে যে তারা নির্বাচনটা বাতিল করে দিয়েছে।
তবে অনেকগুলো প্রশ্ন তিনি তুলেছেন, যেমন যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের কতজন দায়িত্ব স্খলন করেছেন।
তিনি বলেন “ওনারা (নির্বাচন কমিশন) বলছেন সিসিটিভিতে দেখেছেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে তড়িৎ গতিতে এ্যাকশন নিতে হবে। মানুষকে সেটা জানাতে হবে, যাতে করে মানুষের আস্থা ফিরে আসে নির্বাচন কমিশনের উপর।”
তিনি বলেন, “এটা ইভিএমে সমস্যা না। এই একটি আসনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে সব আসনে সিসিটিভি লাগাতে পারবেন কিনা জানি না। যদি না পারেন তাহলে বিকল্প কী হবে- সেটাকে একটা শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে দেখা উচিত।”
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ ধারায় বলা আছে ইসির দায়িত্ব হল সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় বলা আছে নির্বাচন কমিশনের যে ক্ষমতা আছে, তাতে তারা অন্য আইনকে প্রভাবিত না করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে- অর্থাৎ তাদের অনেক ক্ষমতা দেয়া আছে বলে বলছেন মি. হোসেন।
তিনি বলছেন, “মাঠ পর্যায়ে যারা এই কাজটা করেছে পুলিশ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং অফিসার- সবার ক্যামেরার রেকর্ড আছে। সেটা ধরে ধরে দেখতে পারেন। এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে সিসিটিভি লাগাতে হবে, যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে, ইলেকশন কমিশনকে এ্যাকশনের ব্যাপারে দৃঢ় থাকতে হবে, এবং সামনে নির্বাচনে আরো সর্তক থাকতে হবে।”