নির্বাচন বনাম অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ

ড. মাহফুজ পারভেজ :

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রসঙ্গ এবং এর ‘গ্রহণযোগ্যতা’র বিষয়গুলো। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বিশ্বের নানা দেশও বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, শুধু নির্বাচন বা নামকাওয়াস্তে নির্বাচনের কথা কেউ ভাবছেন না। সবার নজরে রয়েছে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য
নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ পর্যন্ত যতগুলো সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কমবেশি বিতর্ক রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। শতভাগ অবিতর্কিত নির্বাচন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সত্যিই অসম্ভব। কালো টাকা ও পেশীশক্তি ভোটের সময় প্রভাব বিস্তার করায় নির্বাচনে জোরজবরদস্তি, সন্ত্রাস, ভোট ছিনতাই হয়েছে। ফলে নির্বাচনী দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো। সে আন্দোলন সর্বাংশে সফল হলে স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশে-বিদেশে দাবি উত্থাপিত হতো না। এবং আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইস্যু সকলের কাছে এত জরুরি হয়ে দাঁড়াতো না।

গবেষকদের মতে, একচ্ছত্র দলীয় শাসন, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও সামরিক স্বৈরশাসকদের দ্বারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র তথা সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার ক্ষতি করা হয়েছে। বিশেষত, হুন্ডা ও গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে ও ভোট ডাকাতির মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে নস্যাৎ করে ভয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল বহু বছর।

সাধারণ মানুষ ভোট দিতে ভয় পেতেন। অবৈধ স্বৈরশাসকগণ মানুষের ভোটাধিকারের মর্যাদা দেয়নি। দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে ভোটের অধিকার তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে জনগণকে। এখন সবার জন্য জরুরি দায়িত্ব হলো, গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখা আর এজন্য অবিতর্কিত, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।

তত্ত্বগত বিবেচনায়, সাংবিধানিক ধারা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সজিব রাখতে নির্বাচন অপরিহার্য। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রাণ। ফলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে মানুষকে ভয়ভীতিমুক্ত করতে হয়। প্রতিটি প্রার্থী ও ভোটারকে নিরাপত্তা দিতে হয়। সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি শ্রেণি ও পেশার মানুষকে প্রণোদিত করতে হয়। নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ তথা প্রকৃতার্থে অংশগ্রহণমূলক করতে সামাজিক, ধর্মীয় ও পেশাজীবী নেতৃত্বকে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি কাজে লাগাতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা কেবলমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রার্থীদের একক দায় নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশীদার প্রতিটি নাগরিকেরও পবিত্র দায়িত্ব। এর মাধ্যমেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং শাসনের বৈধতা অর্জিত হয়।
আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত ‘জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’ সংজ্ঞাটিকে গণতন্ত্রের সর্বজনীন, সর্বাধিক সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি এটাকে গ্রহণযোগ্য ধরা হয় তাহলে ভোটারের উপস্থিতিহীন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অতীতের অনেক নির্বাচন এ কারণে বিতর্কিত হয়েছে। যেমন, সাম্প্রতিকতম ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী জয়ী হন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট পেয়ে। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫ হলেও ভোট পড়ে মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা নিকট অতীতে সর্বনিম্ন।

আমরা জানি, সংসদ নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, কোনো আসনের নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম ভোট পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। কিন্তু, একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ ভোট পেলে তার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্যতা সংকট তৈরি হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনি কি জনপ্রতিনিধি? মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি ১০০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধি কীভাবে হতে পারেন, যেখানে ৯৫ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রদান করেননি। ফলে অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সঙ্গে নির্বাচনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে সমাজের সবাইকে অনুমতি দেয়া একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের স্বার্থে তা বিশেষভাবে প্রতিপালন করা দরকার।

ফলে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের স্বীকৃত মূল কথাই হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার পালাবদল। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যদিয়ে একই দল বারবার ক্ষমতায় আসে, সেটিও অগণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেটিকে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। তাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জরুরি এবং ভোটারহীন বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা কাম্য নয়, যা গণতন্ত্রকে ও নির্বাচনকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আশার কথা হলো, ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে গত ১০ বছরে দেশে তরুণ ভোটার বেড়েছে দুই কোটি ২৫ লাখের বেশি। এই সময়ের মধ্যে যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮-২৮ বছর। তাদের তরুণ ভোটার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ তরুণ ভোটাররা শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার চিন্তা ধারণ করেন। অনেক চিন্তাভাবনা করেই উৎসাহী হয়ে জীবনের প্রথম ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাবেন তারা। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে তরুণ ভোটাররাই একটি বড় নিয়ামক হবেন।

কিন্তু ভোটের আগেই অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য  নির্বাচন ঘিরে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিলে এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে আপত্তি উত্থাপিত হতে থাকলে তা প্রার্থী, ভোটার ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নেতিবাচক চাপের সৃষ্টি করে একটি অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করতে পারে। তাছাড়া নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে মেরূকরণ চলছে, তার নানামুখী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করা যায় না।

বিশেষ করে, ৭ই জানুয়ারির গুরুত্বপূর্ণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ, তখনো এ বিষয়ে সরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তাদের মতোই হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন্সের সমন্বয়ক জন কিরবি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।’ অন্যদিকে, ভারতের অনলাইন ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে একদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ আছে, অন্যদিকে ভিন্ন স্বার্থ আছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বিশ্লেষণ করা হয় যে, কীভাবে ভারত ও চীন এক শিবিরে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষ নিয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।

বিদেশের মতো দেশের ভেতরও নির্বাচন নিয়ে মেরূকরণ ও আলোড়ন রয়েছে। বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবীগণ দফায় দফায় বিবৃতি দিচ্ছেন। সর্বশেষ বিবৃতিতে তারা ‘নির্বাচনের পুনঃতফসিল ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের দাবি’ জানান। তবে বিবৃতিদাতাদের বিএনপির দালাল বলছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমরা প্রথম থেকে বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছি, আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তারা সাড়া দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি গুরুত্বপূর্ণ দল। তারা অংশ নিলে নির্বাচনটা অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক হতো, এটা সকলেই ফিল করে।’ সোমবার (১৮ই ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জাপানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন সিইসি।

সিইসি আরও বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সেটি নির্বাচনের পরে দেখা যাবে।’ ‘আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা’, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা সেই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। সেটি নির্বাচনের পরে দেখা যাবে।’

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

মানব জমিন