যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার সর্বশেষ ১৬-১৭ অক্টোবর ঢাকা সফর করে গেলেন। ঢাকায় এটি তাঁর তৃতীয় সফর। এর আগে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং গত বছর নভেম্বরে ঢাকা সফর করেছিলেন। প্রতিবারই তিনি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, গত সাত-আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘টপ টু বটম’ একইভাবে বাংলাদেশে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন প্রত্যাশা করেছে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর বাইডেন আমাদের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ মার্চ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যেহেতু পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি আমাদের দুই দেশের জনসাধারণের গভীর মূল্যবোধের কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।’
বস্তুত বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে মার্কিন কূটনীতির অগ্রাধিকার, সেটি উচ্চারণে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মোটামুটি ছয়টি শীর্ষ স্তরের সবাই গত এক বছরে সশরীরে ঢাকা সফর করেছেন বা ‘ভার্চুয়ালি’ কথা বলেছেন।
শীর্ষ ব্যক্তি সেক্রেটারি অব স্টেট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিংকেনের সঙ্গে ১১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে অন্যান্য ইস্যুর সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। পরের মাসে, ২৪ মে অ্যান্টনি ব্লিংকেনই ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের লক্ষ্যের সমর্থনে’ নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। সেখানে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া অবদমনে দায়ী অথবা সহায়তাকারী যে কোনো ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়। ঘোষণায় বলা হয়, মে মাসের ৩ তারিখেই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৩ মে ওয়াশিংটনে ‘ইউএস-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব সংলাপে’ বাংলাদেশ পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড নেতৃত্ব দেন। সেখানে স্টেট ডিপার্টমেন্টে এই চতুর্থ শীর্ষ ব্যক্তি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন।
১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলেট একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকা সফর করেন। তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টে দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি এবং ‘গুরুতর’ ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ও পরামর্শক। সফরকালে ডেরেক শোলেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ছাড়াও অন্যান্য অংশীজনের বৈঠক করেন এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষার ওপর জোর দেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যান ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগর সম্মেলনে ১৩ মে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, ভারত মহাসাগরীয় সহযোগিতার কথা বললেও গত ২২ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে ফোনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন। পাশাপাশি আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর ঢাকা সফরের কথাও বলা যায়।
ডেপুটি সেক্রেটারির অধীনে চতুর্থ স্তরে রয়েছেন ছয়জন আন্ডার সেক্রেটারি। তাদের মধ্যে ‘পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স’ বিষয়ক বর্তমান আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের কথা আগেই বলেছি। তাঁর অভিন্ন স্তরের সহকর্মী নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ১১-১৪ জুলাই ঢাকা সফর করেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে একযোগে কাজ করার ওপর জোর দেন।
আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুলান্ডের অধীনে পঞ্চম স্তরে, অঞ্চলভিত্তিক সাতজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দায়িত্বে রয়েছেন ডোনাল্ড লু। ১১-১৪ জুলাই উজরা জেয়ার ঢাকা সফরসঙ্গী ছিলেন তিনিও। এর আগে ১৩-১৪ জানুয়ারিও তিনি ঢাকা সফর করেন। তাঁর অধীনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ষষ্ঠ শীর্ষস্তরে রয়েছেন চারজন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি– পাকিস্তানের জন্য এলিজাবেথ হর্স্ট, ভারতের জন্য ন্যান্সি আই. জ্যাকসন, আফগানিস্তানের জন্য টমাস ওয়েস্ট এবং বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার জন্য আফরিন আক্তার।
প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বশেষ আফরিন আক্তারের সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কী বার্তা পাওয়া গেল? আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুরু থেকেই পরস্পরবিরোধী মত স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই এমন ধারণা দিতে চাইছে, ওয়াশিংটন থেকে চাপ থাকলেও তা ‘ম্যানেজেবল’। সর্বশেষ দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে।’ অন্যদিকে বিএনপি শুরু থেকেই যা বলে আসছে তার সারমর্ম হচ্ছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত না করে ওয়াশিংটন ছাড়বে না। বাস্তবে আফরিন আক্তারের সর্বশেষ ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে ওয়াশিংটনের ভূমিকা বিষয়ে তিনটি দিক স্পষ্ট।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যা বলার, বলা হয়ে গেছে। নির্বাচনের আগের তিন মাস পরিস্থিতির ওপর নজর রাখবে ওয়াশিংটন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দফায় ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটা পালিত হচ্ছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ভাষ্য, নির্বাচনের আগে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কোনো প্রতিনিধির শেষ সফর। তার মানে, নির্বাচন পর্যন্ত আর বিশেষ কোনো ‘চাপ’ ওয়াশিংটন থেকে আসছে না?
দ্বিতীয়ত, শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্যমতে, আফরিন আক্তারের সঙ্গে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের চা চক্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকেই ভূমিকা রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যাতে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ মনে হয়। তার মানে, বিরোধী দলগুলোর প্রত্যাশামতো যুক্তরাষ্ট্র ‘সরাসরি মাঠে’ নামছে না; বরং গ্যালারিতে বসতে চাইছে? তৃতীয়ত, আফরিন আক্তার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের থিঙ্কট্যাঙ্ক আইআরআই ও এনডিআই সমন্বয়ে গঠিত প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা সফর করে যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে, বাইডেন প্রশাসন তা সমর্থন করে। ওই সুপারিশমালার প্রধান বিষয়টি ছিল, একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ। কিন্তু এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন কোনো ভূমিকা নেবে না বলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারও সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন।
তাহলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গত এক বছর ধরে মার্কিন কূটনৈতিক মিশনের বঙ্গানুবাদ কী দাঁড়াচ্ছে? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিজেদেরই সংলাপ ও সমঝোতা করতে হবে। ওয়াশিংটন কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে যাচ্ছে না। দেশীয় ফেসবুকার বা প্রবাসী ইউটিউবাররা যেসব নাটকীয় পরিস্থিতির কথা বলে গগন বিদীর্ণ করে চলছেন, সেগুলোর সমর্থন আপাতত পশ্চিম দিগন্তে মিলছে না।
অবশ্য সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতে জি২০ সম্মেলনেও শেখ হাসিনার সঙ্গে জো বাইডেনের সাক্ষাৎ হয়েছে। এ ছাড়া একই মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। সেখানে কী কথা হয়েছে, আমরা জানি না। রাজনীতিতে অনেক সময় প্রকাশ্য বক্তব্যের চেয়ে অপ্রকাশ্য আলোচনা যে বেশি গুরুতর, তা কে না জানে?
শেখ রোকন: লেখক ও গবেষক; সহযোগী সম্পাদক, সমকাল