ড. মইনুল ইসলাম : ১৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। জাতীয় পার্টিসহ কিছু ছোট রাজনৈতিক দল এ পর্যন্ত নির্বাচনে আসার কথা বলেছে। তা ছাড়া ধারণা করা হচ্ছে যে বিএনপিতে ভাঙন ধরিয়ে বেশ কিছু নেতাকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে সমর্থ হবে আওয়ামী লীগ।
তবে এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত একতরফা নির্বাচনকে কোনোমতেই বৈধতার লেবাস পরানো যাবে বলে মনে হয় না। দেশে-বিদেশে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ ধরনের চিন্তাভাবনা সরকার ও সরকারপ্রধানের জন্য বুমেরাং হবে। বিশেষত, বক্ষ্যমাণ কলামে বিষয়টির বৈদেশিক পরিপ্রেক্ষিতটিকে ফোকাস করা হয়েছে।
প্রকাশ্যে না বললেও মার্কিন সরকার নিশ্চিত হয়েছে যে ২০১৮ সালের বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যালট-কারচুপির আশ্রয় নিয়ে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে লাইনচ্যুত করে ফেলেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যা করেছে সেটা ছিল লজ্জাজনক ব্যালট জবরদখল, যেটা মোটেও আবশ্যক ছিল না। অনেকে মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং তাঁর উপদেষ্টারা জনগণের এই নাড়িস্পন্দন ধরতে পারেননি।
জনগণের কাতার থেকে উঠে আসা দল আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ, পুঁজি-লুটেরা এবং পুঁজি পাচারকারীদের দল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ চিহ্নিত করছে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? সে জন্যই তাদের ভোট কারচুপির চিন্তা করতে হয়েছে ২০১৮ সালে।
বর্তমান সরকারের নানা আচরণে অনেক দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্রকে বৈশ্বিক নীতির অংশ হিসেবে নতুন করে গ্রহণ করার পর বিভিন্ন আলামত থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি খুব বন্ধুসুলভ নয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল। আমি মনে করি, র্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি বাংলাদেশে গেড়ে বসা বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে কিছুটা পরিত্রাণ দেয়, তাহলে দেশ উপকৃত হবে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সরকারের বৈরী আচরণ তখনকার মার্কিন প্রশাসনের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। তদানীন্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যাপারটি সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এতত্সত্ত্বেও মার্কিন পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হলো। এর আগে বাংলাদেশকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে মার্কিন সরকার মার্কিন নেতৃত্বাধীন চীন-বিরোধী সামরিক জোট ‘কোয়াড’ এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যে আমন্ত্রণ বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। কোয়াড ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবিত সামরিক জোট। কিন্তু বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে চলে যায়।
এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আয়োজিত পরপর দুটি গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে অসন্তোষ রয়েছে, তা এতে স্পষ্ট হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপাল ওই গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ভোটের রাজনীতি চালু থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাদ পড়ে। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাতজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।
জঙ্গিরা যে মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল, তাতে তাদের দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখেই জঙ্গিবাদী ঘাতক বাহিনীকে নির্মূল করার কোনো বিকল্প নেই। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, হার্ট-অ্যাটাক—যে নামেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে ডাকা হোক, তা সভ্যতাবহির্ভূত। ২০১৬ সালের পর দেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস অনেকখানি কমে গেলেও ক্রসফায়ারের মতো আইনের শাসন থেকে বিচ্যুতি রাষ্ট্রের শাসকদের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। দরকার ছিল অতি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজন জঙ্গি খুনিদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তি বিধান করা।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল। আমি মনে করি, র্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি বাংলাদেশে গেড়ে বসা বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে কিছুটা পরিত্রাণ দেয়, তাহলে দেশ উপকৃত হবে।
সরাসরি বলছি, লাইনচ্যুত ভোটের রাজনীতি মেরামত করে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যদি আওয়ামী লীগ যত্নবান না হয়, তাহলে জাতি বিপদে পড়তে পারে, যদি বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নেয়। এমনকি এই ইস্যুতে খোদ জাতিসংঘও কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যদি ফেডারেল রিজার্ভে জমা রাখা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করার মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিংবা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অবরোধ আরোপ করে, তাহলে আমাদের বিপদের সীমা থাকবে না। এমনিতেই ডলার–সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে পুঁজি পাচার এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দ্রুত পতন অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
আওয়ামী লীগকে বর্তমান পর্যায়ে অতি-আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করতে পারবে না মনে করলে বড় ভুল হবে। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে থাকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েও আগামী নির্বাচন একতরফাভাবে করে পার পেয়ে যাবে, তাহলে বড় ভুল হবে। ভারত, চীন কিংবা রাশিয়ার সমর্থনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না।
- ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
- প্রথম আলো