- অ্যাডভোকেট এম এ করিম
- ১৬ অক্টোবর ২০২২, ২০:১০, আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২২, ০৬:১০
১. দ্বাদশ জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে নির্বাচনী দিনক্ষণ দীর্ঘ দেড় বছর দূরত্বের অবস্থানের পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন-ইসি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতির পরিমণ্ডল সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রচণ্ড উত্তপ্ত। তখনকার পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার দেশবাসীকে যেন জানান দিয়েছেন দেশে জাতীয় সংসদ এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে আজ কোনোরকম বিরোধী আন্দোলন নেই, নির্বাচনকে ঘিরে নেই দেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট এবং নির্বাচন কমিশনে নেই কোনো প্রকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে দেশের বেশির ভাগ বিরোধী দল, সুশীলসমাজ, দেশের জনগণ আজ হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের স্বার্থে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আপসহীনভাবে প্রতিবাদমুখর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দৃশ্যমান একজন কৌশলী এবং কথামালার অভিনেতা। বিগত দু’টার্মের প্রধান নির্বাচনের পথে হাঁটলেও তার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। নির্বাচনকে নিয়ে বিরোধী দলগুলোর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, সাথে সাথে স্পষ্ট মন্তব্য করেছেন, অধিকাংশ বিরোধী দল এবং সুশীলসমাজ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, ইভিএম প্রয়োগে তারা বিরোধী। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক প্রারম্ভিক পর্যায়ে যখন ৩০০ আসনে ইভিএমের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করেন, তখন কালবিলম্ব না করে নির্বাচন কমিশনার ইভিএম ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তই নেননি। তিনি তাৎক্ষণিক উপরোক্ত বিবৃতি দিয়ে সরকারপ্রধান ও ক্ষমতাসীন দলকে ‘কোনো প্রকার তোয়াক্কাই করেন না’ ও জনগণকে সেই বার্তা দিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাকে নিরপেক্ষ শক্তিধর প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিরোধী মহল ও জনগণ আস্থার মধ্যে গণ্য করতে আরম্ভ করতে থাকেন।
২. পর্যায়ক্রমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দিনে দিনে তার যথার্থ স্বরূপ জাতির সামনে প্রকাশ করতে লাগলেন। তিনি অকপটে বলে ফেললেন, ‘বিরোধী দলগুলোর সাথে যেসব সংলাপ করেছেন তাদের মতামতের কোনো প্রকার মূল্যায়ন বা তোয়াক্কা না করে ইসির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৫০টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে বিরোধী দলের মতামতকে চূড়ান্তভাবে তিনি অবজ্ঞা এবং অপমানিত করেছেন। উল্লেখ্য, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি; ইসি নিয়োগে প্রারম্ভিক পর্যায় হতে তারা বিরোধিতা করেছিল। বিএনপির ধ্যানধারণার বাস্তব প্রতিফলন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতোমধ্যেই ঘটালেন। দায়িত্ব পালনের ঊষালগ্নে তিনি বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিকতা এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দ্বাদশ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে বলা যাবে না মর্মে ও প্রকাশ্যভাবে বিবৃতি দিতে কোনো তোয়াক্কা করেননি। দেশের সংবিধানে নির্বাচনে কমিশনারকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়ার জন্য। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারের পক্ষাবলম্বন না করলে নির্বাচনকালীন সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন তিনি।
৩. দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সুষ্ঠু অবাধ গ্রহণযোগ্য, ভোটারের উপস্থিতিতে ওই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হউক তার বিপরীতে তাদের অবস্থান। সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার গণতন্ত্রকে দেশ থেকে বিদায় করে দীর্ঘ এক যুগের অধিক কালব্যাপী ক্ষমতাসীন। তারা সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার করলেও সংবিধানকে ভূ-লুণ্ঠিত করে নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীন থাকার শতভাগ নিশ্চয়তা তাদের চাই। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনই তাদের ভরসা। যেকোনো মূল্যে নির্বাচন কমিশনকে ষোলো আনা তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে চাই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় বসানোর পথে হেঁটে আগেভাগেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে তাদের আগের সুর পাল্টিয়ে নির্বাচনে কয়টি দল এলো না এলো, তাদের কিছু যায়-আসে না, তাদের দায়িত্ব একটি নির্বাচন করার বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষমতাসীনদের ভাবনা বিবৃতিও তদ্রূপ। ক্ষমতাসীনদের নিয়োগপ্রাপ্ত আমলাসর্বস্ব নির্বাচন কমিশন জনগণের, ভোটারদের কোনো প্রকার তোয়াক্কা করার তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।
সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নই তাদের যেন গুরুদায়িত্ব। এ ছাড়া দেশে ৭০-৮০টি ইভিএম সচল, বাদবাকি ইভিএম কেনার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয়। তাদের হাত ধরে বিদেশ থেকে ইভিএম ক্রয় করা ইত্যাকার কিছু কাজেই তারা মশগুল। দেশের স্বার্থ, গণতন্ত্রের স্বার্থ, ভোটারদের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ তাদের যেন দেখভাল করার কিছু নেই।
৪. বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে হুদা কমিশনের প্রধান জনাব নুরুল হুদা এক সপ্তাহ আগে এক বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন ‘ব্রিটেনে গণতন্ত্র আসতে ২০০ বছর লেগেছিল’। কী ভয়ঙ্কর উক্তি! ব্রিটেনে তো ২০০ বছর আগে গণতন্ত্রই ছিল না, ভোটাধিকার পদ্ধতি ছিল না। এ অবস্থায় ২০০ বছর সংগ্রামে অসংখ্য মানুষের জীবন দিয়ে দেশ শাসনের নিয়ামকশক্তি গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজ তারা পৃথিবীর এক নম্বর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গর্বিত জাতি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের শুভযাত্রা শুরু। সে মতে ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান দেশকে উপহার দিলেন। দেশ শাসনে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠ উপহার। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বিদ্যমান ছিল।
তারপর ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল। গণতন্ত্রের বিপত্তি এসেছে গণতন্ত্রের হাত ধরে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলাতেই মইন-ফখরুদ্দীনকে এবং দেশ-বিদেশের চক্রান্তের হাত ধরে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট সরকারকে ক্ষমতায় আনার পর থেকে। ক্ষমতাসীনরা সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা বিলুপ্ত করে নির্বাচনের নামে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা জয় পেয়ে যাওয়ার রাজনীতির ইতিহাসে এক নবতর আবিষ্কার। নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দলীয় সরকার অধীনে রেখে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির ফর্মুলা মামলা, হামলা, গ্রেফতার, গুম, খুন; নির্বাচনের দিনক্ষণের পূর্বে বিরোধী প্রার্থীদের এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ ডিবির ধরনার মাধ্যমে এলাকা ছাড়ার এক অভিনব কৌশল।
৫. প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অধীনস্থ নির্বাচনে কমিশনার দিয়ে দেশের রাজনীতির পরিমণ্ডলে দ্বাদশ নির্বাচনকে নিয়ে যে অভাবনীয় সঙ্কটসঙ্কুল অবস্থায় নিমজ্জিত তা থেকে ক্ষমতাসীনদের পরিত্রাণের উপায় হিসেবে যতসব কৌশল তাদের স্কন্ধে নিয়েছেন। অংশগ্রহণমূলক সৃষ্ট নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স যাবে, প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ ভোটকেন্দ্রে থাকবে, থাকবে না শুধু ভোটারের উপস্থিতি। ফলাফল ঘোষণা বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন প্রার্থীর জয়লাভ। জনাব কাজী হাবিবুল আউয়াল আগের দু’টি নির্বাচন কমিশনারকে ডিঙিয়ে বিরোধী দল ও ভোটারদের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে শুধু একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের পুনর্বহাল করে হুদা কমিশনের মতো বক্তব্য দিয়ে তাদের মেয়াদকালীন সময় অতিবাহিত করার কৌশল অবলম্বন করেছেন।
উপসংহার : ১০০ ভাগ গ্যারান্টি সহকারে বলা যায়, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়ার শতভাগ ঐকান্তিক ইচ্ছা পোষণ করলেও ক্ষমতাসীন সরকার তার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তা ভণ্ডুল করে দেবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে এরূপ অবৈধ হস্তক্ষেপ নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব ফেলবে না; ক্ষমতাসীনরা যে জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মানতে রাজি নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলাকে রাজসিংহাসনে বসাতে হবে তার বিকল্প কিছু নেই। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ওই বরফ গলে যাবে, সংবিধানে পুনঃতত্ত্বাবধায়ক অবস্থান করবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক