নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে আর কত লজ্জিত হবো

  • মো: হারুন-অর-রশিদ
  •  ০৭ জুন ২০২৩, ২০:০৭
নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে আর কত লজ্জিত হবো। – ছবি : সংগৃহীত

প্রবাদে আছে- ‘যার এক কান কাটা, সে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটে, যার দুই কান কাটা সে হাঁটে হাটের মাঝখান দিয়ে।’ এই প্রবাদের সহজ তর্জমা করলে দাঁড়ায়, এক কান কাটা লোকের একটু হলেও লজ্জা শরম আছে আর যার দুই কান কাটা তার লজ্জা শরম কিছুই নেই। কেউ তাকে লজ্জা দিলেও সে লজ্জা পায় না। লজ্জার অনুভূতিও তার থাকে না। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের অপরাধে র‌্যাব ও র‌্যাবের সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্যাংশন দিলে কিছু দিনের জন্য বিচার বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমলেও অতি সম্প্রতি নওগাঁর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকার পরও তাকে র‌্যাব আটক করে নিয়ে যায় এবং র‌্যাব হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের নেশা থেকে র‌্যাব এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ স্যাংশনও তাদের লজ্জা দিতে পারেনি।

প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার রয়েছে। কেউ অপরাধ করলে তার বিচারের জন্য আইন আছে, আদালত আছে। পুলিশ, র‌্যাব কারো বিচার করতে পারে না। কাউকে হত্যাও করতে পারে না। অপরাধ দমনের জন্য শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টকে ধরে এনে আইনে সোপর্দ করা, বিচার বিভাগের রায় বাস্তবায়ন করাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাজ। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা সরকারকে খুশি করার জন্য সরকারের আইন বহির্ভূত আদেশ নির্দেশ মোতাবেক কাউকে নির্যাতন, গুম , হত্যা করে সেটি তাদের কাজ হতে পারে না। সুলতানা জেসমিন অপরাধী হলে আইনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত। অথচ তার বিরুদ্ধে আগের কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে ধরে আনা হলো? কেন তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হলো? এ দায় কার?

২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোট হরণ করে ক্ষমতা আরোহণের পর থেকেই সরকার ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকারের সমালোচনামূলক কোনো কথা, লেখা কিংবা বক্তৃতা সরকার কোনোভাবেই হজম করতে পারছে না। তবে মনে হয়, সরকার সমালোচনাকে ভয় পায়। কারণ তারা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। এখন জনগণ যদি রুখে দাঁড়ায়, তাহলে তাদের ক্ষমতায় থাকার খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে সরকার জনগণকে দমিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক নিপীড়নমূলক আইন জনগণের ওপর প্রয়োগ করে কাউকে জেলের ভাত খাওয়াচ্ছে আবার কাউকে হয় গুম নতুবা খুন করছে যাতে জনগণ ভয়ে সরকারের সমালোচনা থেকে নিবৃত থাকে।
নিম্নে উল্লেখ করা কিছু খণ্ডচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে, সরকার জনগণকে কিভাবে দমিয়ে রাখতে চায়। ‘করোনা বিধিনিষেধের সময়ে সরকারের খানা জরিপ অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলা ছিল সবচেয়ে গরিব এলাকা আর নারায়ণগঞ্জ জেলা ছিল সবচেয়ে ধনী এলাকা। কিন্তু ত্রাণ সহায়তা কুড়িগ্রামে গেছে সবচেয়ে কম এবং নারায়ণগঞ্জে গেছে সবচেয়ে বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অসঙ্গতির বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী দিদারুল ভুঁইয়া। এ কারণে প্রথমে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখে কালো কাপড় বেঁধে প্রায় সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয়া হয়। ওই মামলায় পাঁচ মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছে তাকে।’ দিদারুল ভুঁইয়ার ভাষ্যমতে, লেখক মোশতাক আহমেদ তার বন্ধু ছিলেন। একই মামলায় তারা জেলে ছিলেন। এর মধ্যে মোশতাকের ভাগ্য হয়নি জান নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার। তার সেই ভাগ্য হয়েছে জান নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার।’

ভোট দিতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়ায় ইমতিয়াজ কাজল নামে এক ব্যক্তির নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দেয়ায় তাকে ১০ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। আর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এন ইউ আহমদ প্রায় পাঁচ বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার ঘানি টানতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনেক ক্ষতিতে পড়েছেন। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে- তার অপরাধ হয়নি। ওই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এখন তার প্রশ্ন হলো, ‘সরকার এই আইনের মাধ্যমে তাকে যে, পাঁচ বছর নির্যাতন করল, ১১ মাস জেলে কারা নির্যাতন করল, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতি করল, তার পড়ালেখার ক্ষতি করল- এর দায়ভার কে নেবে? বা ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’

এভাবে প্রতিনিয়তই যার তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য একটি আইন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে যারা অত্যাচার করে, নির্যাতন করে, শোষণ করে, দুর্নীতি করে সেই শাসক শ্রেণীকে রক্ষা করার জন্য। এই আইন করা হয়েছে গুম করার জন্য, গুমকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। ভোটাধিকার হরণকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। দেশের স্বার্থ বিদেশের কাছে বিকিয়ে দেয়াকে নির্বিঘ্ন করার জন্য।’ অথচ গণতন্ত্রের ভাষা হলো- আমি ভাতের কথা বলব, কাপড়ের কথা বলব, অধিকারের কথা বলব, স্বাধীন মনে লিখব, কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করে গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করছে পদে পদে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সম্প্রতি এই আইনে মামলা দায়েরের আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে প্রথমে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তারপর অভিযুক্তকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। জেসমিন সুলতানা ও প্রথম আলোর সাংবাদিকের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। এখানে জেসমিনের বেলায় আরেকটি মজার বিষয় হলো- মৃত্যুর পরদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেসমিন সুলতানাকে আসামি করা হয়। অথচ মামলার আগেই কাউকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩-এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

ইত্যাদি কারণে আজ প্রশ্ন উঠেছে- ‘র‌্যাব’ ও ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ আদৌ প্রয়োজন আছে কি না। দেশের বেশির ভাগ জনগণই মনে করে, র‌্যাব ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করার কাজে ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, এই আইনটি ‘কণ্ঠরোধের হাতিয়ার’ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। শামস, জেসমিনের ঘটনা সেটিই নতুন করে প্রমাণ করল। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিশ্বের এ যাবতকালের সবচেয়ে কঠোর কালাকানুন (ড্র্যাকোনিয়ান) বলে মন্তব্য করেছে যে আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে (নয়া দিগন্ত, ১২ এপ্রিল-২০২৩)। এখানে আতঙ্কের আরো বড় জায়গা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাই সাধারণত বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক এমনকি যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত না কিন্তু সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের সাথে একমত না এমন ব্যক্তি, যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু একটা লিখেন তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছে। এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এতে মানুষের মতপ্রকাশ স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই শঙ্কা থেকেই গণতন্ত্রপ্রেমী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের আইনজীবী, অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এই আইনটি অবশ্যই বাতিল করা প্রয়োজন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আমরা লজ্জিত হচ্ছি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোকে নিয়ে। সম্প্রতি কানাডার পার্লামেন্টে (হাউজ অব কমন্স) দেশটিতে ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টির একজন এমপি একটি পিটিশন উত্থাপন করেছেন যেখানে বাংলাদেশে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করতে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে সমর্থন করতে সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই পিটিশনে দাবি করা হয়, ‘সরকারের বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলা এবং তার বাহিনী ও সশস্ত্র কর্মীদের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শনের একটি ব্যবস্থা চালু করার অভিযোগ রয়েছে। সরকারের দুর্নীতি, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ এবং অন্যান্য অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের মতো বিষয়গুলো মোকাবিলার জন্যই এগুলো করা হচ্ছে, যা কল্পনারও বাইরে (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ৭ এপ্রিল-২০২৩)। তিনি পিটিশনে আরো অভিযোগ করেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল, সমালোচক, বুদ্ধিজীবী, সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখতে, তাদের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এবং জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার দমন-পীড়ন করছে।’

যুক্তরাষ্ট্রও জোর দিয়ে বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা গুম, খুন ও অপহরণের সাথে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে সবচেয়ে জোর দিয়ে যে বিষয়টি দেখা হচ্ছে তা হলো- আগামী নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পুরো বিশ্ব। তারা চায় এই নির্বাচনটি এশিয়া এবং পুরো বিশ্বের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

আজকে আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত হচ্ছি যখন সারা বিশ্ব থেকে আমাদের নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। যখন প্রশ্ন তোলা হয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিচার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ নিয়ে। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কমিটমেন্ট ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা করার। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সেই কমিটমেন্ট থেকে সরে গিয়ে আজ আমরা একনায়কতান্ত্রিক তথা ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। আর ফ্যাসিজমের শক্তির কাছে নুয়ে পড়ছে আইনের শাসন, বিচার বিভাগ ও মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ভোগের সুযোগ। যেকোনো মূল্যে আমরা যদি এই ত্রাহি অবস্থা থেকে মুক্ত হতে না পারি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবান্বিত ইতিহাস যেমন কলঙ্কিত হবে, তেমনি জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের কাছে ধিকৃত হতে থাকব।

[email protected]