নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশের ঘাটতি দেখছেন কূটনীতিকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সহায়ক বা অনুকূল পরিবেশে এই মুহূর্তে ঘাটতি দেখছেন বাংলাদেশে কর্মরত অনেক বিদেশি কূটনীতিক। তারা বলছেন, সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে জাঁকজমকপূর্ণ; কিন্তু এখন পর্যন্ত এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বরং রাজনৈতিকভাবে রয়েছে চাপা উত্তেজনা।

বিদেশি কূটনীতিকরা এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন। যেমন তারা বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার ইসির প্রতি অনেক রাজনৈতিক দলের রয়েছে অনাস্থা। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রয়েছে দুই মেরুতে– এই সংকট নিরসনে সংলাপের পরিবেশও তেমন দেখা যাচ্ছে না। তাই নির্বাচন ঘিরে সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এসব কারণেই সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

অনেক বিদেশি কূটনীতিকের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের মতামত সংকুচিত হয়েছে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ঘটনাও ঘটছে। ভোটের মাঠে সব দলের প্রার্থীর প্রতি প্রশাসনের সমান আচরণেও রয়েছে ঘাটতি।

বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশের মূল্যায়ন জানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও রাশিয়া দূতাবাস এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘ কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে কেবল চীনের দূতাবাস ও জাতিসংঘ কার্যালয় সমকালের প্রশ্নে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদান করে। অন্য দূতাবাস ও হাইকমিশনের কূটনীতিকরা তাদের পর্যবেক্ষণ জানান নাম না প্রকাশ করার শর্তে। বাংলাদেশে জাতিসংঘ কার্যালয়ের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সমকালকে বলেন, ‘কাকে ভোট দেবে– সেটি এ দেশের মানুষের একান্তই নিজের সিদ্ধান্ত। তবে নির্বাচনে যেন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানান, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আশা করে জাতিসংঘ। কোনো দেশ অনুরোধ করলে জাতিসংঘ এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করে। তবে বাংলাদেশ সরকার কোনো সহযোগিতা চায়নি বলে জানান তিনি।

ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এ দেশের জনগণই ঠিক করবে। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর নীতিতে বিশ্বাস করে চীন। বেইজিং এই নীতি অনুসরণ করে যাবে।’ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক ও বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে চীন আত্মবিশ্বাসী বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিদেশি কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষণ হলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈরী সম্পর্ক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অর্জিত প্রবৃদ্ধি টেকসই করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নির্বাচন ঘিরে যেসব ইস্যুতে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা ও সংলাপে সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন তারা। নাম না প্রকাশের শর্তে পশ্চিমা এক রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশে যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে জানিয়েছে। কারণ তারা সংঘাতের আশঙ্কা করছে। চিঠি দিয়ে ইসিকে তারা বলেছে, নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশের শর্তগুলো পূরণ হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) সুপারিশ থেকেও তা বোঝা যায়। তিনি বলেন, ভোটের তিন মাসের ওপর বাকি। এই সময়ের মধ্যে সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে নির্বাচনী পরিবেশের ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা প্রয়োজন।

এদিকে ইসি নিজেও মনে করছে, নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনও হয়ে ওঠেনি। বিরোধপূর্ণ বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংকট নিরসন হচ্ছে না এবং এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছু নেই। একাধিক গণমাধ্যম প্রতিনিধিকে দেওয়া আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে যুক্ত ‘ধারণাপত্রে’ এমন অবস্থান তুলে ধরেছে ইসি। আগামী ২৬ অক্টোবর বৈঠকের জন্য ইসি ওই আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে করণীয় সম্পর্কে আরেক পশ্চিমা কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। আস্থার সংকট সৃষ্টি হয় এখান থেকেই। তাছাড়া, দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির মূল কাজ হলো আইন কার্যকর করা, আইনকে পাশ কাটিয়ে বিকল্প ব্যাখ্যা দাঁড় করানো নয়।

তিনি বলেন, গত ৫০ বছর বাংলাদেশ নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে মসৃণ গণতন্ত্রের ধারা কার্যকর করতে বেগ পেতে হবে। তবে জাতীয় স্বার্থে এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। কারণ গণতন্ত্রের বিকল্প উন্নত গণতন্ত্র, অন্য কিছু নয়। গত ৬ থেকে ২২ জুলাই ঢাকা সফর করে ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা জানান ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান হাই রিপ্রেজেনটেটিভ জোসেপ বোরেলে। ইসিকে চিঠি দিয়ে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করতে অর্থবহ সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। পাশাপাশি ৫ দফা সুপারিশ তুলে ধরে তারা। চলতি মাসে বাংলাদেশ সফরকারী মার্কিন ওই পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার বিষয়টি পুরোনো। তবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে নির্বাচনে প্রাণহানি হয়েছে কম। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাস্তায় সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপ না হলে সহিংসতা বাড়তে পারে।

অনেকেই মনে করেন, আইনগতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ইসির। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ইসি তার ক্ষমতা খুব কমই প্রয়োগ করতে পারে। ভোটের দিন স্বাধীনভাবে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং নির্বাচনী কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়ার সক্ষমতা ইসির নেই। এটি নির্বাচনে অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আরও সংযত হওয়া দরকার। পাশাপাশি তাদের নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তারা। তাদের মতে, বাক্‌-স্বাধীনতার সুরক্ষা ও নাগরিক সমাজ যাতে মতামত প্রকাশ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী সবার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা হবে না– এমন প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেন তারা। সেই সঙ্গে ইসির নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা।

সমকাল