- সুরঞ্জন ঘোষ
- ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৩৪, আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:৪১
লিখতে গিয়ে শুরু করতে হয় সারা বাংলাদেশে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন নির্বাচন শুরু হয়েছে; এ নির্বাচনে কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, তা আলোচ্য বিষয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়। কারণ এখান থেকেই গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারের ভ‚মিকা অনন্য।
গণতন্ত্রে কেন্দ্রীয় সরকার নীতি প্রণয়ন করবে এবং স্থানীয় সরকার সেসব নীতি বাস্তবায়ন করবে- এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু জনগণের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে; সেহেতু বিভিন্ন ধরনের সেবা ও পণ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এসব প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে সক্ষম। আমরা জানি, বাংলাদেশের সংবিধানে ৫৯ ও ৬০ ধারায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিচে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সরকারের স্তর প্রতিষ্ঠা করা এবং সেসব স্তর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
সংবিধানের এই বিধানের আলোকেই সরকার দেশে স্থানীয় সরকার এবং গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা জানি, গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তর ইউনিয়ন পরিষদ প্রায় ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্য সব স্তরের চেয়ে নিজেদের এখতিয়ারের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ স্বাধীনভাবে কাজ করে; যদিও এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নির্ভরতা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। এই দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়; কারণ দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সময় স্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিয়ে এমন অনেক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য দলের কেন্দ্রে সুপারিশ করেন যাদের দলের সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি অন্য দল থেকে আসা অনেক প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ায় দলের যোগ্য ও নিবেদিত প্রার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন।
বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন বিক্রি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন দেয়ার ফলে দলগুলো স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
আমরা যদি বিশেষভাবে লক্ষ করি, তাহলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে সেটি হলো- এই সহিংসতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক ছিল। তবে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক সহিংসতার পরিমাণ অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এই প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, এবারের সহিংসতা মূলত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে; কারণ বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।
একটি মৃত্যুও কারো জন্য কাম্য নয়। আর সেই মৃত্যু স্বাভাবিক না হয়ে যদি হয় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার কারণে, তাহলে স্বজনদের দুঃখ অনেক বেড়ে যায়। এই সহিংসতায় যে শুধু বিবদমান দলগুলোর সদস্য নিহত হচ্ছেন, বিষয়টি সে রকম নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ, এমনকি পথচারীরাও এই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যেটি কখনোই কাম্য হতে পারে না।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। সংসদীয় কিছু আসনের পাশাপাশি এই ইউপি নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করা তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে যথেষ্ট। দেশে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে গিয়ে নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব নয়।’ এর ফলে সহিংস পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ব্যবহার না করতে পারার অসহায়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যে শঙ্কা এবং নির্বাচন ঘিরে যে সঙ্ঘাত, বিশৃঙ্খলা ও হতাহতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার দায় নির্বাচন কমিশন এবং সরকার কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না; কারণ আইন ও বিধিমালায় নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ প্রয়োগ আমরা লক্ষ করছি না। এমনকি এর আগেও যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেই সময়ও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
রাজনীতি হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণে। কিন্তু এখন রাজনীতি জনগণের স্বার্থে নয়, দল ও ব্যক্তির স্বার্থে করা হয়। এটিকে ‘ফায়দাভিক্তিক রাজনীতি’ বলে। এ কারণে এখানে সহিংসতা করতে দ্বিধা করা হয় না। কারণ এখানে স্বার্থ জড়িত।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এসব সহিংসতায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে। বোমাবাজির ঘটনাও ঘটেছে, নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ জন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ২০ জন, যার মধ্যে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন দু’জন। এসব ঘটনায় মূলত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রেরও অপব্যবহার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক নির্বাচন বিশ্লেষকই মনে করেন, এবার তৃণমূলের এই নির্বাচনে শান্তি রক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপের অপ্রতুলতাই বাড়তি সহিংসতার জন্য মূলত দায়ী।
অতীতে দেখা গেছে, প্রধান নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হতো এবং সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। ফলে সেসব এলাকায় সহিংসতা অনেকটাই কম হতো। এবার ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাত্র দু’টি জেলায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। জেলা দু’টি হলো নরসিংদী ও কক্সবাজার। এর মধ্যে নরসিংদীতে ৯ জন এবং কক্সবাজারে পাঁচজন মারা গেছেন। নির্বাচনের আগেই অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে জেলা দু’টিকে চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে জেলা দু’টিতে সহিংসতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত; অনেক প্রাণ রক্ষা পেত। জানা যায়, নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেশি হতে পারে, এমন আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিভাগের অর্ধেকের মতো ইউপি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
এসব ইউপিতে নির্বাচনের আগে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। তা হলে এ নির্বাচনী সহিংসতা ও ব্যাপক প্রাণহানির দায় কার? কেউ কেউ এসব সহিংসতার জন্য রাজনৈতিক উসকানিকেও দায়ী করেছেন। কিন্তু সেটি শুধু মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। নির্বাচনী সহিংসতায় যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে, তা শুধু নির্বাচন নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যদি বেড়ে যায়, তা হলে বৈধ অস্ত্র জমা নেয়াটাও বিপজ্জনক; কারণ মানুষ তার নিজের নিরাপত্তার জন্যই বৈধ অস্ত্র রাখে। বৈধ হোক, অবৈধ হোক, নির্বাচনে যেসব জায়গায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, সহিংসতা হয়েছে, সব ঘটনা দ্রুত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রয়োজনে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায়ও প্রাণহানির অনেক ঘটনা ঘটেছে। এই সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি কঠোর হাতে দমন করা না হলে হতাহতের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। ভবিষ্যতের নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।
এখন প্রশ্ন থেকেই যায়, আগামী সাধারণ নির্বাচন এবং আগামী বছর নির্বাচন কি কাক্সিক্ষত পর্যায়ের সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? পারবেন কি ভোটদাতারা তাদের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভোট দিতে? ভোটপ্রার্থীরা কি পারবেন তার নির্বাচনমণ্ডলীর সাথে নিরাপদে যোগাযোগ স্থাপন করতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে দেয়া সম্ভব নয়। তবে কিছু ধারণা দিয়ে আগামী সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা করার প্রয়াস রয়েছে এতে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীনদের ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে যা হয়েছিল তা হয়তো ভবিষ্যতে আর কোনো দিনই হবে না। কিন্তু এর ছায়াও যেন এ দেশের কোনো নির্বাচনে আর না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে, করতে হবে দেশের রাজনীতিকদেরই। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে, গ্রহণযোগ্য হলে রাজনীতিকরাই প্রশংসিত হবেন; শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিশ্বের সর্বত্রই।
বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে রয়েছে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে। ছোট্ট ভালো কাজটি তাদের চোখে দেখা দেবে অনন্য কর্মরূপে, একটি অনুকরণীয় উদ্যোগরূপে।
আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণতন্ত্রের আবেদন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা তারা বরাবর উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিকরূপে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। ত্যাগ স্বীকারও করেছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশীদার হয়ে।
লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা
সভাপতি, সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটি