- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৯, আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২১:০১
প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘বিচার মানি তবে তালগাছ আমার।’ বর্তমান সরকারি রাজনৈতিক দলের অবস্থাও তাই। তারা গণতন্ত্র আর ভোটের অধিকারের কথা বলতে বলতে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র আর ভোটের রাজ্যে আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকিদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। তাদের অবস্থা এই রকম যে, কাগজ-কলমে জমির মালিক কে সেটি দেখার দরকার নেই। দখল সূত্রে সেই জমির মালিক ও জমিতে জন্মানো ফসলাদি, বৃক্ষলতা সবই তাদের। গায়ের জোরে সব দখল তাদেরই চাই। তাই মাঠের রাজনীতি থেকে শুরু করে মুখের রাজনীতি সবই তাদের দখলে রাখতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাদের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ার কারো নেই। যা করবে তাই মেনে নিতে হবে। সেটি ভোট চুরি হোক আর দুর্নীতির মহা রাজ্য হোক। যে মুখ খুলবে নিঃসন্দেহে সেই বেটা রাজাকার অথবা তার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ রাজাকার ছিলেন এই তকমা পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এই দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক চেহারা এমন যে, জনগণ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার ‘উপেন’ আর সরকার হলো ‘ভূ-স্বামী’।
১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচন নিয়ে কম জল ঘোলা করেনি আওয়ামী লীগ। সেই এক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রময় আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করাতে বিএনপি সরকারকে বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগ। আর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাস করাতে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি সরকার, যার পুরো বেনিফিট পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। সুবিধাজনক সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তাদের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করল। কেন তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো? আওয়ামী লীগের যেকোনো পর্যায়ের নেতাকে এই প্রশ্ন করলে তাদের মুখস্থ উত্তর, এর জন্য দায়ী বিএনপি। কেন বিএনপি দায়ী? সে ক্ষেত্রে তারা মাগুরার উপনির্বাচন আর বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর উদাহরণ সামনে আনেন।
মাগুরার উপনির্বাচনে বিএনপি সরকার ভুল করেছে, এটি ঠিক কিন্তু বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি তো ছিল সংসদে পাস করা বিল। মাগুরা উপনির্বাচনের উপমা দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা ১৪ বছরের শাসনামলে গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকেই গিলে ফেলল। সেখানে আওয়ামী লীগ কোনো সমস্যা দেখছে না; যত দোষ বিএনপির। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর থেকে সারা দেশের ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচন কোনোটিতেই জনগণ সঠিকভাবে ভোট দিতে পারেনি। তারপরও আওয়ামী লীগ গলা উঁচু করেই বলে- তারা নাকি গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে সাধারণ জনগণের অভিমত হলো- ভোট আর মাঠের রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি আর দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় দলীয় নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে মানুষের মধ্যে একটি উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো। দীর্ঘ লাইনে মানুষ ভোট দেয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত। পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য রাত-দিন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভোট চেয়ে বেড়াত। মানুষ বুঝতে পারত, অমুক দিন ভোট হবে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভোটের সেই সংস্কৃতি রূপকথার গল্পের মতো মনে হবে। সেই আমেজও নেই; সেই উৎসবও নেই। এখন ভোট মানেই মানুষ বুঝতে পারে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীই জিতবে। হয় আগের দিন রাতেই ভোট হয়ে যাবে নতুবা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যেতে পারবে না। গেলেও নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে না। এই শঙ্কার কারণে কোনো ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। অর্থাৎ জনগণের কাছে ভোটকে একটি মূল্যহীন বিষয়ে পরিণত করেছে। যেমনটি কর্তৃত্ববাদী সরকার বা সামরিক সরকারের আমলে হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ এই সত্যটিকে কোনোভাবেই স্বীকার করতে চায় না।
বিরোধী দলীয় রাজনীতির ওপর প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়ে অযাচিত হামলা-মামলা করে যত প্রকারে নাজেহাল করা যায়, সবভাবেই করছে। মিডিয়া জগতের মুখ বন্ধ করার জন্য আইসিটির খড়গ প্রস্তুত। কথা বললেই যেতে হবে লাল দেয়ালের ভেতর। অথবা অপহরণ, নতুবা গুম। যদিও র্যাবের ওপর স্যাংশন দেয়ার পর গুম, খুন, অপহরণের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমে এসেছে; কিন্তু ভয়ের জায়গাটি একটুও কমেনি। এভাবে ক্ষমতাসীন সরকার সর্বক্ষেত্রকে ভয় দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অথচ ৭৩ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দেশ ভাগের পর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ইতিহাস গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ইতিহাস। এই সময় পর্যন্ত এই দলটি বিরোধী দলে থেকেই আন্দোলন করেছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসতে না পারার কারণেই খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের দাবিদারও তারা। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তারাই প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের রথযাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল।
পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করেছে এই আওয়ামী লীগই। বিরোধী দলে থেকেই জোটবদ্ধ আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগই আজ ঠিক উল্টো কাজ করছে। বিরোধী দলকে দমন করে, নামকাওয়াস্তে ভোট করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য মরণপণ চেষ্টা করছে।
একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডার বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের রাজনীতিকে দমন করার কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দল তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এই সুযোগে আওয়ামী লীগ যে বেপরোয়া রাজনীতির সংস্কৃতি চালু করেছে তাতে রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যন্ত সাধারণ জনগণকে রাজনীতিবিমুখ হতে বাধ্য করেছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলেছে প্রশাসনযন্ত্রের। কোনো রাজনীতিবিদের কথা প্রশাসনের কেউ শুনতে ও মানতে নারাজ। মনে হয়, প্রশাসনযন্ত্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনযন্ত্রের ওপর রাজনীতিরই কর্তৃত্ব করার কথা। কিন্তু কর্তৃত্ব করছে প্রশাসনের অদৃশ্য শক্তি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে। কারণ প্রশাসনযন্ত্র মনে করছে, তারাই আওয়ামী লীগ সরকারকে জীবিত রেখেছে। এই সরকার টিকে থাকার পেছনে সব কর্তৃত্ব তাদেরই। আওয়ামী লীগ যখন জনগণের পরিবর্তে প্রশাসনের কাছে ধরনা ধরেছে তখন থেকেই তারা এমপি-মন্ত্রীদের পাত্তা দিতে নারাজ। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে অনেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যকেও প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, থানার একজন ওসি পর্যন্ত এমপি-মন্ত্রীদের আদেশ-নির্দেশ মানছে না।
রাজনীতিতে এখন গালি আর মিথ্যার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। গালিগালাজ, মিথ্যা আর দাম্ভিকতাপূর্ণ শব্দ রাজনীতির ভাষা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভদ্রলোকের সন্তানরা এখন আর রাজনীতিতে যুক্ত হতে নারাজ। তারা মনে করে, অসভ্যতা রাজনীতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। এখানে সভ্যতা টিকে থাকতে পারবে না। মন্ত্রী-এমপিদের ভাষাজ্ঞান জাতিকে লজ্জিত করছে। আগের দিনে মানুষ অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কাছে যেতেন ভাষাজ্ঞান শেখার জন্য। বিরোধী রাজনীতিবিদদের ন্যূনতম সম্মান না দিয়ে মিথ্যা আর যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাষায় আক্রমণ করা হয় তা কোনো সভ্য সমাজের ভাষা হতে পারে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে বের হয়ে আসা ‘খেলা হবে’-এটি রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। অরুচিকর ভাষা ব্যবহার করে রাজনীতির সুষ্ঠু সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে। এক সময় রাজনীতির মধ্যে যে বাগ্মিতার সংস্কৃতি ছিল এখন মিথ্যা, ইতর, অব্যবহারযোগ্য শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সেই বাগ্মিতার সংস্কৃতিও ধ্বংস হতে চলেছে।
বিগত ১৫ বছরে নির্বাচনী রাজনীতির সংস্কৃতি ধ্বংসের সাথে সাথে নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা নিয়েও আছে ব্যাপক প্রশ্ন। আগেকার দিনে যারা রাজনীতি করতেন এবং সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্য তারাই নির্বাচনে প্রার্থী হতেন। কিন্তু এখন রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণভার চলে গেছে। এখন যারা নির্বাচনে প্রার্থী হন তারা হয় ব্যবস্যায়ী নতুবা তাদের বিরুদ্ধে আছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজের তকমা। এ ছাড়া এমন শ্রেণীর ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য করা হচ্ছে যাদের নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেই রাজনৈতিক জ্ঞান। সংসদকে এখন গানের আড্ডাখানা বানিয়ে ফেলেছে। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে হিরো আলমও এমপি হওয়ার দৌড়ে জিততে গিয়েও তাকে হারানো হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যের কী কাজ, তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদি সহজ করে বলি তাহলে বলতে হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে গিয়ে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়কে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে। একটি নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, জনগণসহ নির্বাচনের সাথে জড়িত সব স্টেকহোল্ডারকে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মস্তিষ্কের মধ্যে নিরপেক্ষ বিবেকের উদয় ঘটাতে হবে। শপথের মূল্য দিতে হবে।
জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য করতে পারে। সরকার অনির্বাচিত কায়দায় দীর্ঘদিন টিকে থাকতে চাইলেও বাকি সবার ঐক্যবদ্ধতা, শপথ পালনের দৃঢ়তা ও জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করলে নির্বাচনের হারানো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না। এটি করতে পারলে গণতন্ত্র যেমন ফিরে আসবে, স্বাধীনতার মূল চেতনাও আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে।