ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার সার কারখানা। ফাইল ছবি
দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে- নির্বাচনের আগে এমনটিই উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। যে কারণে গত বছরের শেষ সময়ে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাকি রেখেই উদ্বোধন করা হয়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির পাতানো নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানাও উদ্বোধন করা হয়। এখন এই উন্নয়নই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রকল্পের জাপানি ঋণের ডলারের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে সরকার। যে কারণে দেশে সারের উৎপাদনশীলতা অব্যাহত রেখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে এই সার কারখানার চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান স্বীকার করেছেন যে, প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এই কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার পিএলসি’র বৈদেশিক ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আর প্রথম কিস্তির ডলারের অংশ বাবদ প্রায় ৮৬৭.৮১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় সরাসরি সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই অর্থ পরিশোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগামী ১২ মার্চের মধ্যে জাপানি মুদ্রা ইয়েনে দ্বিতীয় কিস্তির ৫৩৭.৩৫ কোটি টাকা এবং ২১ মে’র মধ্যে মার্কিন ডলারে প্রথম কিস্তির ৩৩০.৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ এই কয়েকমাসে সর্বমোট ৮৬৭.৮১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে ২ শতাংশ হারে দণ্ড হিসেবে সুদ আরোপ হবে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ. বি. এম. মো. আজিজুল ইসলাম বাংলা আউটলুককে বলেন, বিদেশি ঋণের বিষয়ে আরও বিচক্ষণ হতে হবে। ডলারের সংকটকে সার কারখানার উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে আনা উচিৎ ছিল।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, সক্ষমতা না থাকলে কোনোভাবেই উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া উচিৎ নয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন সার কারখানাটির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দেশে ডলারের সংকট প্রকট হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানা প্রকল্পের জন্য মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক কেউ মার্কিন ডলারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ফলে বাজারে ডলার সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার শীর্ষক প্রকল্পটি সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। দেশের ইউরিয়ার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ করে প্রকল্পের অর্থায়ন করা হয়েছিল। এই ঋণের বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টি দেওয়া আছে। নির্ধারিত সময়ে মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা না হলে ২ শতাংশ হারে দণ্ড সুদ আরোপ হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় কারখানা এখনও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। নিজস্ব কোনো আয় না থাকায় কারখানার পক্ষে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে মধ্যে ঋণের দ্বিতীয়য় কিস্তির টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর আগে, ঋণের ইয়েন অংশের ঋণের প্রথম কিস্তি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পরিশোধ করা হয়। কারখানার নিজস্ব আয় না থাকায় অর্থ বিভাগের মৌখিক পরামর্শ মোতাবেক আমদানিকৃত ইউরিয়া সারের ভর্তুকি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ পিআইএফ (পোস্ট ইম্পোর্ট ফিন্যান্স) পরিশোধ না করে কারখানার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ।
তবে নিরবচ্ছিন্ন ইউরিয়া সার আমদানির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০২৪ সালে সরকারি ৪টি ব্যাংকের অনুকূলে মোট ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কাউন্টার গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছে। সরকার প্রদত্ত কাউন্টার গ্যারান্টির বিপরীতে পিআইএফ ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে এলসি’র বিল মূল্য পরিশোধ করা হয়। প্রতিটি ঋণের মেয়াদ ১৮০ দিন। আমদানিকৃত ইউরিয়া সারের বিপরীতে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্ষন্ত ব্যাংক কর্তৃক সৃষ্ট পিআইএফ ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৯৩৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার মধ্যে ৩ হাজার ৬৫২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার ঋণ মেয়াদোর্ত্তীণ হয়ে গেছে। ঋণের অর্থ পরিশোধ না করা গেলে অচিরেই সমুদয় ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত পিআইএফ নীতিমালা মোতাবেক খেলাপি ঋণদাতাকে নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি স্থাপন ও নতুন ঋণ সৃষ্টিতে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকারের কাছে ট্রেড গ্যাপ বা ভর্তুকি বাবদ আমদানিকৃত ইউরিয়া সারের বিপরীতে ৮ হাজার ৫৬৪ কোটি ৬০ কোটি টাকা, উৎপাদিত ইউরিয়া সারের বিপরীতে ২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, টিএসপি সারের বিপরীতে ১৫৭ কোটি ৮৯ কোটি টাকা এবং ডিএপি সারের বিপরীতে ৫৩৩ কোটি ২৩ লাখ টাকাসহ মোট ১১ হাজার ৭৮২ কোটি বকেয়া রয়েছে। বিসিআইসি’র সক্ষমতা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানার কার্যক্রম শুরু হলে সার আমদানির ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। এর ফলে দেশের মোট বার্ষিক ২৬ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় কারখানাগুলো একসঙ্গে ১৯.২৪ লাখ মেট্রিক টন সার উৎপাদন করবে। দেশের কারখানাগুলো বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ টন উৎপাদন করছে। বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) জানায়, কারখানাটি ৩০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ১১০ একর জমিতে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কারখানাটির দৈনিক সার উৎপাদন হবে ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন।
ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার সার কারখানা প্রকল্পের বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ও বাণিজ্যিক ঋণ ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা; ঋণদাতাদের মধ্যে রয়েছে জাইকা, এইচএসবিসি ও ব্যাংক অব টোকিও মিত্সুবিশি ইউএফজে লিমিটেড।
জানা গেছে, কারখানার দুটি বাষ্পীয় গ্যাস জেনারেটর ৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম এবং প্ল্যান্টটি চালানোর জন্য ২৮ মেগাওয়াট প্রয়োজন।
এটি বাংলাদেশের প্রথম সার কারখানা, যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্লু গ্যাস থেকে পরিবেশদূষণকারী আহরণ করা হবে এবং ক্যাপচার করা কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে ইউরিয়া সারের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে (প্রায় ১০ শতাংশ)। এটি দেশে ‘অত্যাধুনিক, শক্তি সাশ্রয়ী ও সবুজ’ সার কারখানা, যা ইউরিয়া সারের আমদানি কমিয়ে দেবে এবং কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে।
গত বছরের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় নবনির্মিত ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা (জিপিইউএফএফ) উদ্বোধন করেন। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ধরনের বৃহত্তম কারখানা। আওয়ামী লীগ সরকার বলছে, কারখানায় উৎপাদিত সার দেশের সার আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সহায়তা করবে। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক এ সার কারখানা বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন সার উৎপাদনে সক্ষম।
তিন দশকের পুরোনো কারখানাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নতুন করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন এবং প্রকল্পের শুরু থেকেই বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল প্রস্তুত করা হয়েছে। পরিবহন সুবিধার লক্ষ্যে ঘোড়াশাল রেলস্টেশনের সঙ্গে কারখানার সংযোগের জন্য একটি রেললাইন নির্মাণের কাজ এখন চলছে।
২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিসিআইসির মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিসিআইসি’র পক্ষে সংস্থার চেয়ারম্যান শাহ্ মো. আমিনুল হক, মেসার্স এমএইচআই জাপানের পক্ষে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজিমি নাগোনো এবং সিসি সেভেন চায়না কন্সোর্টিয়ামের পক্ষে সিইও ওয়াগ ড্যালিন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।