- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৩ আগস্ট ২০২২
সংসদীয় রীতি-নীতি মোতাবেক নির্বাচন পরিচালিত হয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তত্ত্বাবধানে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় এটি একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। পৃথিবীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অলিখিত শাসনতন্ত্র ব্রিটেনে। ইতিহাস-ঐতিহ্য, নিয়ম-কানুন ও রীতি-নীতি প্রথা ও পদ্ধতিতে শাসিত এই দেশ। জরুরি অবস্থা বা যুদ্ধকালীন অবস্থা ব্যতীত এই রীতি-পদ্ধতির ব্যতিক্রম ঘটেনি। শত শত বছর ধরে অনুসৃত হওয়ার কারণে এটি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। জাতীয় নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন এ নিয়ে বিতর্ক হয় না যে, কার অধীনে কিভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ধারায় শাসিত হওয়ার ফলে ব্রিটেনের অনুকরণ, অনুসরণ ও অনুশীলন করে আসছে। পাকিস্তানের আধা ঔপনিবেশিক আমলে সংসদীয় পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসৃত না হলেও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ওই রীতি-পদ্ধতির প্রতি ছিল।
পাকিস্তানের সর্বশেষ ও একমাত্র জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। দীর্ঘ ২৩ বছরে গণতন্ত্রের অনুশীলন না হওয়ার ফলে মানুষের বিশেষত পূর্বাংশে ক্ষোভ, ক্রোধ ও অসন্তোষ প্রশমিত হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার অনিবার্য ফল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যের কথা, যারা ঔপনিবেশিক আমলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম এমনকি প্রাণপাত করেছেন তাদের হাতেই গণতন্ত্রের পতন অবধারিত হয়ে উঠে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। সর্বাত্মকবাদের পরিণতি হিসেবে সামরিক শাসনে শাসিত হয় বাংলাদেশ।
১৯৯০ সালে নাগরিক আন্দোলনের ফলে অবশেষে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হলেও সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজ অধরাই থেকে যায়। আবারো দুর্ভাগ্যের বিষয় হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর অসংসদীয়, অগণতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপের উল্লেখ করতে হয়। ব্রিটেনসহ অন্যত্র সংসদীয় রাজনীতিতে যে প্রথা-পদ্ধতি পবিত্রজ্ঞানে অনুসৃত হয়েছে, এখানে ঘটেছে তার উল্টোটি। যারা লঙ্কা গেছে তারাই হনুমান হয়েছে- অর্থাৎ সরকারি দল সরকারের মতো আচরণ করেছে, গণতন্ত্রের মতো নয়। যে নির্বাচনব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস ও সমঝোতা- তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। সন্দেহ-অবিশ্বাসের কালো মেঘ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে করেছে আচ্ছন্ন। নির্বাচনে কারসাজি যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
বিগত ৫০ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাকে আমরা রাজনৈতিক উন্নয়ন বা রাজনীতির উন্নতি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি বলে থাকি, তা ঘটেনি। বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের ভাষায়, ‘ওয়ানস অ্যাগেইন এট দ্য স্টার্টিং পয়েন্টে’ ঘুরপাক খেয়েছে রাজনীতি। গ্রামের লোকেরা বলে, ‘আল্লাহ আল্লাহ বলো ভাই ফিরে আসলাম গোড়ায়’। বিগত ৫০ বছরে রাজনীতি ভালো-মন্দ মিলিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই যেন ফিরে এলো। কাকতালীয় হলেও বিষয়টি আমাদের উপলব্ধিকে আরেকবার শানিত করবে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দখলে ছিল ২৯৩ আসন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আসনসংখ্যা ২৫৯+ জাতীয় পার্টি ২০+ ওয়ার্কার্স পার্টি ০২+ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ০৩+ বিকল্প ধারা ০২+ জাতীয় পার্টি মঞ্জু ০১+ তরিকত ফেডারেশন ০১ = ২৮৮টি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মাত্র পাঁচটি আসন লাভ করে। অর্থাৎ, ১৯৭৩ সালে যে অবস্থান ছিল ক্ষমতাসীন দলে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৮ সালে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার কথা যদি বলেন, তাহলেও মুখ ফেরাতে হবে। ১৯৭৩ সালে ক্ষমতাসীন দলের ক্রমহ্রসমান জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও গোটা দেশে তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তারপরও নগণ্যসংখ্যক বিরোধীদলীয় প্রার্থীর জয়লাভ তাদের সহ্য হয়নি। মেজর (অব:) হাফিজের বাবাকে নির্বাচনের দিন হাইজ্যাক করা হয়। আশঙ্কা ছিল সেখানে শীর্ষ নেতৃত্বের পরাজয়ের। বরিশালে মেজর জলিলের নিশ্চিত জেতাকে পরাজয় বানিয়ে দেয়া হয়। সেখানে হরনাথ বাইনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। খন্দকার মোশতাককে বিজয়ী করার জন্য হেলিকপ্টারে ব্যালট বাক্স ঢাকায় আনা হয়। সেদিনের গল্পের চেয়েও আজকালকার গল্প আলিফ লায়লাকেও হার মানায়। সেদিনের বিষয়টা ছিল ব্যক্তিক ও স্থানীয়। কিন্তু আজকের বিষয়টি জাতীয় ও সামগ্রিক। আমরা সবাই জানি, সেদিন যেমন এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল স্বল্পাকারে এখন এটিও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে। সেদিন হয়তো লজ্জা শরম কিছুটা ছিল। রাখঢাক কিছুটা ছিল। কিন্তু এখন এটি ওপেন সিক্রেট।
আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, প্রয়াত উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এক সমাবেশে কৃতিত্বের সাথে বর্তমান নির্বাচনী ‘ব্যবস্থাপনার’ জন্য গৌরব দাবি করেছিলেন। গত ৩১ জুলাই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা হয়, আমরাই করিয়েছি’। আরেকটি বড় পার্থক্য হলো- সেদিন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসরি নির্দেশ বা প্রতিশ্রুতির কথা আমরা জানি না। কিন্তু এবারে অর্থাৎ গত দু’টি নির্বাচনে আমরা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছি। ২০১৪ সালের বোগাস নির্বাচনের পর তিনি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্বীকার করেছিলেন- আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। বাইরের লোকেরা যেমন তা বিশ্বাস করেছিল, ভেতরের লোকেরাও আশ্বস্ত হয়েছিল। সেই নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল- বিরোধীরা আগুন আর মানুষ পোড়ানোর আন্দোলন করে। অথচ ধরা পড়েছিল তাদের লোকেরাই, আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য তারা সেই কাজটি করেছিল। একেই বলে ম্যাকিয়াভেলি বা চাণক্যের রাজনীতি- যেখানে শাসক হবে শেয়ালের মতো ধূর্ত ও সিংহের মতো সাহসী।
২০২৩ সালের নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ-উত্তেজনা চলছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন সংলাপের আয়োজন করেছে। এই রুটিন কাজটি এর আগের দু’টি কমিশন একই ধারায় করেছিল। ভাবখানা এই, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একমত হয়ে কিছু না কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করবেন। কিন্তু ওই দু’টি সংলাপে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং নির্বাচন কমিশন সংলাপের মাধ্যমে বৈধতার সূত্র অন্বেষণ করেছে। এবারের হাবিবুল আউয়াল কমিশন একই ধারায় সংলাপের আয়োজন করেছে। দেশের ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি সংলাপে অংশগ্রহণ করে। সব রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের যদি একটি সারাংশ বা মর্মার্থ তৈরি করা হয় তাহলে দেখা যাবে- সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে, তা হলো নির্বাচনকালীন সরকার।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি। গত ১৭ জুলাই শুরু হওয়া ওই সংলাপ শুধু গণমাধ্যমে প্রচারণার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে বা ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অংশগ্রহণকারী ২৮টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমপক্ষে ১৮টি দল নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে চারটি দল বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন চেয়েছে। তারা অবশ্য নির্বাচনকালীন যেকোনো ভিন্নতর ব্যবস্থাপনার কথা বলেছে। এদের মধ্যে ১৩টি রাজনৈতিক দল স্বরাষ্ট্র ও লোকপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেছে। শাসকদলের শরিক দল রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়-য়ার বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ও মুজিবুল হক মাজভাণ্ডারীর তরিকত ফেডারেশন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। চলমান রাজনীতিতে এটি ব্যতিক্রমধর্মী বটে। এরা তিনটি মন্ত্রণালয়- স্বরাষ্ট্র, লোকপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার সুপারিশ করেছে। চারটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বলেছে। এসব প্রস্তাবনার বাইরে আরো যে বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের অবলুপ্তি। নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রিপরিষদকে অকার্যকর বা স্থগিত রাখার কথাও এসেছে। প্রস্তাবের মধ্যে আরো রয়েছে- জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ না করা। আরো একটি বড় বিষয় প্রায় সব রাজনৈতিক দল উপস্থাপন করেছে, তা হলো- নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করা। তবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবার সরাসরি ইভিএমের বিরোধিতা করেছে।
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘ইভিএমে আমাদের আস্থা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমারও এতে কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে- ইভিএমে ভোট পাল্টে দেয়া হলে কিছু করার নেই। কারণ, ফুল রিচেক করা যায় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইভিএম সম্পর্কে ইসির বিশেষজ্ঞদের কথাও জাতীয় পার্টির নেতাদের মাথায় ঢুকেনি। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছাড়া এভিএম ব্যবহার করা যৌক্তিক হবে না।’
উল্লেখ্য, সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছে। এ কথা স্বীকার করেছেন নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে সংশয় থাকবেই। ইভিএম নিয়ে মতৈক্য না থাকায় এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি। তার মানে হতে পারে এই- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইভিএম ব্যবহারে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়ার ওপর এর সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে মনে করছেন।
অপর দিকে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রথমত, নির্বাচনকালীন সরকারের ধারণা অগ্রাহ্য করেছে। তারা বলেছে, সংবিধান মতেই নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড চ্যাপ্টার’ অর্থাৎ অতীত ও সমাপ্ত অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ। বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়মী লীগ তথাকথিত সংসদীয় সরকার অনুসরণের নামে মন্ত্রিসভা ছোট করে আনে। তারা ভদ্রতা করে এ কথাও বলে যে, এ সময়ে তারা কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবেন না। তবে কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকেনি। প্রায় সব রাজনৈতিক দল যখন ইভিএমের বিরোধিতা করছে, তখন সরকারি দল শক্তভাবে ইভিএম ব্যবহারে একরকম জেদ ধরেছে। বেশ কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী ইভিএমে নির্বাচন হওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল মৃদু সাহস করে বলেছিলেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারভুক্ত নয়। যা হোক, সমাপ্ত সংলাপ অবশেষে এ কথা বলা যায়- নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একরকম মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, এটি ছিল ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ফসল। এতে জাতীয় ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয়। তখনকার বিএনপি সরকার আন্দোলনের ব্যাপকতা ও বিষয়টির ইতিবাচক দিক বিবেচনা করে সংবিধানে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি সংযোজন করে।
বাংলাদেশে যে সব বিষয়ে জনগণের আগ্রহ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে, এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি বিরাট মাইলফলক। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল তার একটি সংবিধানসম্মত সমাধান মেলে। কিন্তু যে আওয়ামী লীগ এর প্রবর্তন করে তারাই তাদের ক্ষমতার স্বার্থে এটি বাতিল করে। যখন তারা বুঝতে পারে, অন্তত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই তাদের নেই, তখন তারা স্ববিরোধিতা ঘটিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, তাদের ১৩টি অধিবেশনের কোনোটিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের কথা বলা হয়নি। যে ৯ জন বিজ্ঞ ব্যক্তি বা অ্যামিকাস কিউরির অভিমত গ্রহণ করা হয়, তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। যে রায়ের অজুহাত দেখিয়ে এ ব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়, সেখানেও অন্তত আরো দু’বারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার জন্য মতামত আসে। কিন্তু সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রের কাছে।
গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রে প্রদত্ত জনমত ও নির্বাচন কমিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকারের পক্ষে। ডা: জাফরুল্লাহ যে জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন, তা মূলত নির্বাচনকালীন সরকারের স্পিরিট থেকেই। তিনি জাতীয় সংস্কারের জন্য জাতীয় সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধি চেয়েছেন- এটুকু যা পার্থক্য। যে নামেই ডাকা হোক- তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতীয় সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার- তা আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সঙ্কটের সমাধান কামনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। একটি নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তা জাতির মৌলিক সঙ্কট এবং সমস্যাকে দূরীভূত করবে। সবাই আশা করেন- সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য জনগণের প্রত্যাশিত আন্দোলনের আগেই সরকারের উচিত বিষয়টির যৌক্তিকতা, বাস্তবতা ও প্রায়োগিকতা মেনে নেয়া। ‘শুভস্য শীঘ্রম’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]