সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন আদালতে খারিজ হওয়ায় ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বিক্ষিপ্তভাবে নয়, সমন্বিত কর্মসূচি চান। বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করা হয়েছে। সুতরাং রাজনৈতিকভাবেই সেটি মোকাবেলা করতে হবে। কেবল আদালতের মাধ্যমে দেশনেত্রীর মুক্তি আসবে না। অবশ্য বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছেন যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে।
আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তবুও দলীয় প্রধানের জামিনের জন্য গত বৃহস্পতিবার আদালতের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপির আইনজীবী ও সিনিয়র নেতাদের ধারণা ছিল যে, শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে মানবিক কারণে হলেও আদালত খালেদা জিয়াকে জামিন দেবেন; কিন্তু বিএনপির সে আশায় গুড়ে বালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ মেডিক্যাল রিপোর্ট জমা দেয়ার পর আদালত তা পর্যালোচনা শেষে জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দলটির আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ করেছেন তারা। অবশ্য বিএনপির হাইকমান্ড বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন কেন্দ্রের নির্দেশনার অপেক্ষায়।
তারা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই। তাদের অভিযোগ বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী। তাকে জামিন না দিয়ে বারবার জামিনে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় আন্দোলনই একমাত্র পথ। অবশ্য দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা। বিএনপির বিভিন্নপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, দলের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত ও কৌশল প্রণয়নে তারা ক্ষুব্ধ।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির এক নেতা বলেন, দলের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের একজন সমর্থক পর্যন্ত জানে আদালতের মাধ্যমে দেশনেত্রীর মুক্তি সম্ভব হবে না; কিন্তু তারপরও আমাদের নেতারা আদালতের দিকেই তাকিয়ে থাকেন কেন তা বুঝে আসে না।
মাদারীপুরের শিবচর থানা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা আদালতের সিদ্ধান্তে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। আওয়ামী সরকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে বন্দী করেছে। আদালত একটি গোষ্ঠীকে খুশি করতেই দেশনেত্রীর জামিন আবেদন খারিজ করেছেন। অথচ আদালত চাইলেই মানবিক কারণে ৭৫ বছর বয়সী এক নারীকে জামিন দিতে পারতেন। সুতরাং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত এখনই ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে নেত্রী মুক্তির আন্দোলন ত্বরান্বিত করা। সেইসাথে বিএনপিতে সুবিধাবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত।
ঢাকার পাশের দু’টি জেলার সাধারণ সম্পাদক বলেন, দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে জীবন দিতেও প্রস্তুত রয়েছে; কিন্তু সিনিয়র নেতারা তাদের সম্পদ রক্ষা ও সরকারের সাথে আঁতাতের কারণে খালেদা জিয়ার দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দী রয়েছেন। সিনিয়র নেতারা শুধু সভা-সমাবেশে হুঙ্কার ছাড়লেও বাস্তবে কোনো প্রতিফলন নেই। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, বেগম জিয়ার মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য হলেও কোনো কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়নি। আমার সন্দেহ হয় যে, বিএনপির সিনিয়র নেতারা কি আদৌ বেগম জিয়ার মুক্তি চান?
বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল আউয়াল খান বলেন, খালেদা জিয়া তো আইনি প্রক্রিয়ায় আটক নন। তাকে যে মামলায় আটক করা হয়েছে সেটি রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যেভাবে দেশনেত্রীকে আটক রাখা হয়েছে সেটিও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। সুতরাং এর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যে প্রক্রিয়া প্রয়োজন সেই প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সিনিয়র নেতারা হুঙ্কার দিলেও আন্দোলনের রূপরেখা এখনো আমরা পায়ইনি। সুতরাং মিটিং-সমাবেশে হুঙ্কার না দিয়ে পরিকল্পনামাফিক একটি কর্মসূচি প্রয়োজন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মক প্রস্তুত আছেন।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি মো: গোলাম সরোয়ার বলেন, আমরা চাই আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে; কিন্তু আদালতের আচরণে বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে যে, আদালতের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে আমরা মুক্ত করতে পারব। তিনি বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই, সেখানে কেউ যদি মনে করে আদালতের মাধ্যমে দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে পারবে তাহলে সেটি হবে বোকামি। আমরা সেই অবস্থাও সৃষ্টি করতে পারিনি যে, বিচার বিভাগ চাপ অনুভব করবে এবং ন্যায় বিচার করবে। এখন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে দুর্বার আন্দোলনের ছাড়া বিকল্প কিছু নেই বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিপ্লব ছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয় না। কেননা ফ্যাসিস্টরা কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ভর করে নিজেদের সুরক্ষা অটুট রেখে দেশ শাসন করে। সুতরাং খালেদা জিয়ার মুক্তি ও ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে দুর্বার গণ-আন্দোলনের বিকল্প নেই।