গত বছর শুরু থেকে দেশে ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। এজন্য খোলাবাজারে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি অন্যান্য দায় মেটাতে ও ঋণ পরিশোধে কমছে রিজার্ভ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের কিস্তি পাওয়ার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে।
বর্তমানে দেশে মোট রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের নির্ধারিত ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভের (জিআইআর) পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন।
যদিও নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভের (এনআইআর) হিসাব প্রকাশ করে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে জিআইআর থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায়, আইএমএফের ঋণ ও ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রা ক্লিয়ারিং (এফসি) হিসাবে লেনদেন নিষ্পত্তির পর পাওয়া যাবে এনআইআর; যা ১৬ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমএফের বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক মূল্যায়নে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত অক্টোবর শেষে বাংলাদেশের জিআইআর কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর এনআইআর কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গ্রস ও নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভের মাঝে পার্থক্য ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে গত শুক্রবার আইএমএফ ও এডিবির ঋণের কিস্তি যুক্ত হওয়ার পর জিআইআর দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এনআরআই দাঁড়াবে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের জিআইআর ছিল ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর ১৫ ডিসেম্বর আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার এবং এডিবির দেয়া ঋণের ৪০ কোটি ডলার বাংলাদেশের রিজার্ভে যোগ হয়।
সূত্রমতে, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে কয়েক বছর ধরেই লুকোচুরি চলছে। এক সময় শুধু মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হতো, যা নিয়ে আপত্তি তুলে আইএমএফ। ঋণের শর্ত হিসেবে গত জুন থেকে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে এটি হলো জিআইআর, যার থেকে কিছু উপাদান বাদ দিলে পাওয়া যাবে এনআইআর। যদিও এনআইআরের হিসাব শুধু আইএমএফকে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত জুনে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভের (এনআইআর) তথ্য প্রকাশ করবে না। এই তথ্য শুধু আইএমএফকে জানানো হবে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বল হয়েছে, গত জুনে দেশে নিট রিজার্ভ তথা এনআইআর ছিল ১৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চার মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে নভেম্বরের শুরুতেই আকুর দায় পরিশোধ করা হয় ১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এতে ওই মাসে নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার কথা। তবে আইএমএফ ও এডিবির ঋণের ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়ার পর নিট রিজার্ভ বাড়লেও তা ১৬ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই থাকবে।
যদিও চলতি মাসের শেষে নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রাখার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে আইএমএফ। সম্প্রতি ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার সময় এ লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। তবে ঋণ ছাড় করা শুরুর আগে প্রাথমিকভাবে ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড় দিয়েছে আইএমএফ। তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয়ে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে গত জুন ও সেপ্টেম্বরেও নিট রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এজন্য আইএমএফের এ শর্ত প্রথম কিস্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন রিভিউ তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে আরএসএফ ফান্ডসহ নিট রিজার্ভ হবে ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার, এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সোয়া দুই মাসের (২.৩ মাস) আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতা থাকবে। তবে আরএফএস ফান্ড বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভ দাঁড়াবে ১৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভের এ পরিমাণকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ প্রসঙ্গে বলেন, রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে নেমেছে, তা সংকটজনক না হলেও উদ্বেগজনক। এটাও ধরে রাখা হয়েছে জোর করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তা না হলে আরও কমে যেত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩০০ কোটি ডলার বা ৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের (২০০ কোটি ডলার) স্তর ছুঁতে পারেনি। এরপর ধীরে ধীরে রিজার্ভ বাড়তে থাকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বৈশ্বিক মন্দা হলে রিজার্ভ সাত বিলিয়ন থেকে কমে পাঁচ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর তা ধীরে ধীরে বাড়ে এবং কভিডের কারণে আমদানি কমে প্রবাসী আয়ে বড় উত্থান হলে ২০২১ সালের আগস্টে মোট রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে এরপর কোনো কোনো মাসে সামান্য বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে।
sharebiz