পুরুষের তুলনায় নারী নিম্নতর—এই ভুল ভাবনার অবসান শুরু হয় মাত্র শ খানেক বছর আগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও নারীদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিম্নতর ভাবা হতো পৃথিবীর বহু দেশে। এই যুদ্ধে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এমন ধারণা কিছুটা দূর করে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তাই ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় নারীদের সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হতে থাকে; তবে তা পুরুষদের তুলনায় অনেক পরে।
যেমন ফ্রান্সে পুরুষেরা প্রথম সর্বজনীনভাবে ভোটাধিকার পান ১৭৯২ সালে, অথচ সেখানে নারীরা সর্বজনীন ভোটাধিকার পান ১৯৪৪ সালে। সর্বশেষ ইউরোপীয় দেশে (লিখটেনস্টেইন) নারীদের এই ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৯৮৪ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশের ১২ বছর পরে।
ভোটাধিকার একটি নাগরিক অধিকার। এ রকম নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালের বৈশ্বিক চুক্তির পর।
এসব অধিকার নারীদের দিলে রাষ্ট্রের তেমন কোনো অর্থসম্পদের প্রয়োজন হয় না, সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতাও খুব একটা হোঁচট খায় না। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় নারীদের ভোটাধিকার, এমনকি নেতৃত্ব, নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি।
তুলনায় কর্মসংস্থান, উপযুক্ত পারিশ্রমিক, স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা—এসব অর্থনৈতিক অধিকার নারীদের সমানভাবে দিলে রাষ্ট্রের অর্থসংস্থানের প্রয়োজন হয়। পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারীর বিকাশবিরোধী সমাজের ভিত নড়ে ওঠে। কারণ, স্বাবলম্বী নারীর স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ থাকে অনেক বেশি।
হয়তো এসব কারণে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ভোটাধিকার এবং অন্য নাগরিক-রাজনৈতিক অধিকারগুলো (যেমন সমাবেশ, ধর্ম পালন ও বাক্স্বাধীনতা, গ্রেপ্তার ও বিচারকালীন অধিকার) নারীদের জন্য প্রায় অবারিত করে দেওয়া হলেও অর্থনৈতিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে অনেক বেশি।
২.
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম বাধা হচ্ছে অর্থসংস্থান। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হলে বছরে ৩৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, কিন্তু এতে লাভ হবে বহুগুণে বেশি। ৮ মার্চ এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাই আহ্বান হচ্ছে: নারীর জন্য বিনিয়োগ করুন, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করুন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্য তুলে ধরা হচ্ছে নারী দিবসের এই আহ্বানের মধ্যে। যেমন ক) নারীরা পারিশ্রমিকহীন সেবাকাজে (যেমন বাসার কাজ, সন্তানদের দেখাশোনা, পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া) পুরুষদের চেয়ে তিন গুণ সময় ব্যয় করেন এবং এসব কাজে তাঁদের সম্মানী দেওয়া হলে এর পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৪০ শতাংশের মতো হতো।
খ) নিম্ন পারিশ্রমিক রয়েছে এমন কাজে মেয়েদের প্রতিনিধিত্বের হার বেশি, উপযুক্ত আয়ের সুযোগ রয়েছে এমন কাজে কম। চাকরিজীবী মেয়েদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি নিয়োজিত আছেন নিম্ন পারিশ্রমিক ও অধিকার রয়েছে এমন অনানুষ্ঠানিক খাতে। উন্নয়নশীল দেশে এটি প্রায় ৯০ শতাংশ। ব্যবসার ক্ষেত্রেও এ অসাম্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় ৩২ শতাংশ কম, নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ কম।
গ) যুদ্ধ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার বেশি হয়েছেন নারীরা। ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যসীমায় থাকা নারীর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩৫ কোটি।
লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে, এটি মানবাধিকার। এর অর্থনৈতিক সুবিধাও রয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে জিডিপি বাড়তে পারে ২০ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, সেবা খাতে পুঁজির সঞ্চালন এবং সুষ্ঠু কাজের সম্প্রসারণের ফলে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৩০ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে এবং এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কম হতে পারে।
সেবা খাতে পুঁজির সঞ্চালন হলে মেয়েরা আরও বেশি তাঁদের পছন্দমতো অর্থনৈতিক কাজ বা উচ্চশিক্ষায় অংশ নিতে পারেন। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কাজ সহজ হয়, নারীর অগ্রগতির সুবিধা সবাই পায়।
৩.
নারীর প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। এমনকি সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদে নারীর জন্য বিশেষ সুবিধামূলক আইন ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আছে। এ ধরনের কিছু আইন (যেমন সংসদ বা স্থানীয় সরকারের নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন, কিছু চাকরিতে কোটা, বিধবা ভাতা) রয়েছে দেশে। অন্য আইনকানুনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান। কিন্তু বাস্তবে নারীরা তা ভোগ করতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রে।
বিশ্বব্যাংকের ‘নারী, ব্যবসা ও আইন ২০২৪’ শিরোনামের প্রতিবেদন এটিই বলছে। সেখানে দেখা গেছে, অবাধ চলাচল, কর্মক্ষেত্র, মজুরি, ব্যবসায় উদ্যোগ, সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর তুলনায় বাস্তব কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকার আরও কম। কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র আইনি অধিকার ভোগ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তান বাদে বাকি সবার নিচে
নিজেদের দিকে তাকালেই আমরা এমন বহু চিত্র দেখি। সংসদে সরাসরি আসনে নারীর মনোনয়ন, সরকারি চাকরিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব, ব্যবসায় নারীর প্রবেশগম্যতা যে কতটা কম, তা আমরা সবাই অনুভব করি। খেলাধুলার ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য পুরুষদের সমতুল্য বা এমনকি বেশি হলেও এ ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ ও প্রদত্ত অনেক কম। তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের শোষণ বেশি, গৃহকর্মীর কাজে নারীদের বেতন খুবই কম, সুরক্ষা নেই বললেই চলে। বিচারিক প্রতিকারও (যেমন সহিংসতার ক্ষেত্রে) নারীরা পায় কম।
এসবের অবসান করতে হলে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। দেখতে হবে মা হিসেবে, নতুন প্রজন্মের প্রথম শিক্ষক ও প্রধান প্রভাবক হিসেবে। নারীদের কর্মসংস্থান, চাকরি ও ব্যবসার সুবিধা বহুগুণে বাড়ানোর তাগিদ তাই শুধু নারী দিবসে নয়, প্রতিদিনই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
- আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
- Prothom alo