পিনাকী ভট্টাচার্য
গত বছরের ১লা নভেম্বর ঢাকার রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে কিশোর আলোর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান ছিল। সেদিন মাঠে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় নাইমুল আবরার। এ ঘটনায় নাইমুলের বাবা মজিবুর রহমান গত বছরের ৬ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে নালিশি মামলা করেন। এরপর চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রথম আলো সম্পাদক, কিশোর আলো সম্পাদকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ।
১৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হলে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে প্রথম আলো, কিশোর আলোর সম্পাদকসহ আটজনের অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করা হয়।
প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কিশোর আলো। সেই মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় গত ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত।
যেদিনকার ঘটনায় এই মামলা, সেদিন প্রথম আলোর সম্পাদক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। আনিসুল হকই নাইমুল আবরারকে বিদ্যুত পৃষ্ঠ হবার পরে কাছের হাসপাতালে না পাঠিয়ে দূরে অনুষ্ঠানের স্পন্সর হাসপাতালে পাঠায়। অভিযোগ আছে, নাইমুল আবরারকে হাসপাতালে পাঠাতেও আয়োজকেরা দেরী করেন। শুধু তাই নয় আবরারের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরেও অনুষ্ঠানটি চলতে থাকায় সেই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সেইসময়ের পত্রিকাগুলোর সংবাদে চোখ বুলালেও দেখা যাবে সবাই অভিযোগের আঙ্গুল আনিসুল হকের দিকেই তুলেছিলো।
পুলিশ যে দশজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় আদালত তার মধ্য থেকে বিশেষ একজনকে বাদ দিয়ে অভিযোগ গঠন করে। সেই একজন কে? সেই একজন হচ্ছে কিশোর আলোর সম্পাদক ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক ও সেইদিন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত আনিসুল হক।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান অব্যাহতি পেলেন না কিন্তু যিনি এই ঘটনার সাথে যুক্ত ছিলেন, যিনি সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন এবং অব্যস্থাপনার পূর্ণ দায় যার সেই আনিসুল হক ঠিকই অব্যাহতি পেলেন। এর কারণ কী? এই অব্যাহতি দেশবাসীকে কী বার্তা দেয়?
এর কারণ একটাই হতে পারে, সেটা হচ্ছে আনিসুল হক ছাত্র জীবনে আওয়ামী রাজনীতি করতেন। বুয়েটে পড়ার সময়ে তিনি জাতীয় ছাত্রলীগ করতেন। জাতীয় ছাত্রলীগ ছিলো শেখ মুজিবের বাকশালের ছাত্র সংগঠন। যা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ভারতপন্থি রাজনীতি করতে থাকে। এই দলটি পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। আর কে না জানে, আওয়ামী লীগের পরিচয় থাকলে বাংলাদেশে এখন সাত খুন মাফ। নাইমুল আবরারের মৃত্যু তো মাত্র একটা জীবন। আনিসুল হকের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোটা এখনো পূর্ণ হয়নি, আরো ছয়টা প্রাণ তিনি অনায়াসেই নিতে পারবেন বা নেবার জন্য সাহায্য করতে পারবেন। আনিসুল হক আওয়ামী লীগের প্রতি আরো কৃতজ্ঞ থাকতে পারবেন।
নাইমুল আবরারের মৃত্যুর ঘটনাতেও আওয়ামী লীগ তার অনুগতকে পুরস্কৃত আর মতিউর রহমানকে চাপে রাখার কাজে ব্যবহার করলো। প্রশ্ন উঠতে পারে এই কাজ তো আদালত করেছে তাই এর দায় কেন আওয়ামী লীগের? এই আদালতই তো সেই আদালত যেইখানে বিচারপ্রার্থী আর বিচারপতির আলাপ হয়, সমঝোতা হয়। ফাঁস হওয়া স্কাইপ আলাপে শুনেছি, একজন আরেকজনকে বলে, আমি খাড়ায়ে যাবো, আপনি বসায়ে দিবেন। এই সেই বিচারবিভাগ যেইখানে রায়ের বাক্য পছন্দ না হলে প্রধান বিচারপতিকেও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। যেই বিচারব্যবস্থায় গুমের কোন শাস্তি হয়না, ক্রস ফায়ার হয় আইনসম্মত। এই বিচার ব্যবস্থা মানবাধিকার কর্মীদের মতে ডিসফাংশনাল।
ব্রিটিশ আমলে একটা আইন ছিলো, তা হচ্ছে নীলকরেরা আত্মরক্ষার জন্য সাতটা পর্যন্ত মানুষ খুন করলেও তাদের কোন বিচারের মুখোমুখি হতে হতো না। নীল চাষের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনকে দমন করতে আর নীলকরদের নীলকুঠির উপরে আক্রমণ ঠেকাতে এই নজিরবিহীন আইন করা হয়েছিলো। এটাকে এই অঞ্চলে দেয়া প্রথম ইনডেমনিটি বলা যেতে পারে। এই থেকেই সাত খুন মাফ বাগধারাটা এসেছে। আওয়ামী লীগারেরা নব্য নীলকর। উনারা অবশ্য নীলের বদলে আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চাষ করেন, সেই চেতনা বিক্রি করেই আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী শাসন চালায়।