আয়কর না দেয়ার অভিযোগ তুলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিসহ (এনএসইউ) দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেই সঙ্গে বকেয়া কর পরিশোধের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে দুই ডজনের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। এদিকে ঈদের আগে ব্যাংক হিসাব জব্দ করায় বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দ্রুতই তা খুলে না দিলে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
জানা গেছে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বরাবর ৪ মার্চ চিঠি পাঠান ঢাকা কর অঞ্চল-১১-এর উপ-কর কমিশনার মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া। চিঠিতে আয়কর আইন ২০২৩-এর ২১৪ ধারা মোতাবেক বকেয়া কর পরিশোধের জন্য বলা হয়। ২০০২-০৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত বিগত ১৬ অর্থবছরে মোট ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার ৫৬৪ টাকা কর পরিশোধ করতে বলা হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিকে। সেই সঙ্গে তা ১৫ মার্চের মধ্যে পরিশোধের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়। কর প্রদানে ব্যত্যয় হলে আয়কর আইন ২০২৩-এর ২৭৫ ধারা অনুযায়ী জরিমানা আরোপসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয় এনবিআরের ওই চিঠিতে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কর পরিশোধের জন্য এনবিআর থেকে চিঠি পেলেও ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে কোনো চিঠি এনএসইউকে দেয়া হয়নি। মূলত ব্যাংক থেকে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। তাদের কাছ থেকেই ব্যাংক হিসাব জব্দের কথা প্রথম জানতে পারি। যেহেতু ভ্যাটের বিষয়টি এখনো সুপ্রিম কোর্টে প্রক্রিয়াধীন, তাই আমরা আইনজীবীকে জানিয়েছি।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র অবশ্য বলছে, প্রাইম ব্যাংকে পরিচালিত এনএসইউর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হলো মর্মে ২৫ মার্চ চিঠি দেন উপ-কর কমিশনার জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া। লিখিতভাবে রদ না করা পর্যন্ত ওই নোটিস বলবৎ থাকবে বলেও চিঠিতে বলা হয়।
২০০৭ সালের ২৮ জুন এনবিআরের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনর্নির্ধারণ করা হলো। ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর হবে।’
২০১০ সালের ১ জুলাই এনবিআরের আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।’
এরপর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৪৬টি রিট করা হয়। ওই দুটি প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের দেয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ আয়কর আদায় থেকে বিরত থাকতে এনবিআরকে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে আইনি লড়াই শেষে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ আদেশ দেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।
আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের ঘটনায় আইনি পদক্ষেপের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এনবিআরের পক্ষ থেকে ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর পরিশোধ করতে চিঠি দেয়া হয়েছে। অথচ ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আপিল বিভাগই কর মওকুফ করেছেন। এক্ষেত্রে এনবিআরের কর্মকাণ্ড আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া আপিল বিভাগ কিন্তু বলেননি আপিলটি গ্রহণ হয়েছে, বলেছেন আপিলটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ও প্রকাশ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায়ে কিছু অবজারভেশন থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ।’
এদিকে আইনগত জটিলতা নিরসনের আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর আদায় না করা এবং ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দ করার মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। একই সঙ্গে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো পুনরায় চালুর নির্দেশনা দেয়ারও অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ১৫ শতাংশ কর দেয়াসংক্রান্ত রিট আপিল নিষ্পত্তি হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তকে ‘অমানবিক’ বলছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন। কর পরিশোধের জন্য প্রায় ২০-২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে এনবিআর থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন রোজার সময়, সামনে ঈদ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন যদি বেতন-ভাতা না দিতে পারে সেটা খুবই অমানবিক হবে। তাই আমরা চাই এ সময়ে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা হোক।’
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়কে কর পরিশোধের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক কর পরিশোধ করায় তাদের দেয়া চিঠি প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
প্রাইম ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ুন কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউনিভার্সিটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান, না অলাভজনক প্রতিষ্ঠান—এটার সংজ্ঞা ঠিক করা দরকার। যদি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে সেভাবে ঘোষণা করা হোক। তারপর লাভ থেকে কর নির্ধারণ করা হোক। যেহেতু বলা হয়েছে ইউনিভার্সিটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, এখানে করের প্রশ্ন কেন আসবে? ঈদের আগে হঠাৎ করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলো, আমরা কীভাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দেব? যদি এক মাসের একটি নোটিস দেয়া হতো সেটাও বিবেচনায় নেয়া যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘গুণগত শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাপোর্ট দেয়া উচিত। যদি কেউ অনিয়ম করে তাহলে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। কিন্তু ঢালাওভাবে ঈদের আগে হঠাৎ অ্যাকাউন্ট জব্দ করাটা সুচিন্তায় নেয়া উচিত।’
আদালতের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রকাশের আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে বলে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর ৪৪ (৭) ধারা অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইন দিয়ে স্বীকৃত অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে কোনোরূপ অর্থ যেমন উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতারা গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি আয়কর হিসেবে প্রদান করা বা অন্যভাবে ব্যয়ের বিষয়টিও বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবেই প্রতীয়মান। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং কর আইনের সাংঘর্ষিক বিভিন্ন ধারা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে পরিবর্তন করা জরুরি।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের বিষয়ে এখনো এনবিআর কিংবা ব্যাংক থেকে কোনো চিঠি পাননি বলে জানিয়েছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. এম লুৎফর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমিও কয়েকজনের কাছে শুনেছি কিন্তু এখনো কোনো চিঠি পাইনি। ট্রেজারার বা অর্থ বিভাগের কেউ এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি পেয়েছেন কিনা নিশ্চিত নই। তবে এমনটি যদি ঘটে থাকে তাহলে আমাদের সবাইকে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হবে।’
একই কথা জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এর সমাধান হবে। আমাদের ট্যাক্স কনসালট্যান্ট ও আইনজীবীরা বিষয়টি দেখবেন। তারপর যে ফিডব্যাক পাবে সেটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাবে। তবে এ বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা এনবিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সোমবার সকাল ১০টায় তারা আমাদের সময় দিয়েছে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য।’
Bonik Barta