অলিউল্লাহ নোমান 27 November 2023
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ মডেলের আরো একটি নির্বাচন সামনে। মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জরুরী আইনের সরকারের সাথে ভারতের মাধ্যমে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন একটি নির্বাচনি স্টাইলে। ক্ষমতায় এসে নির্বাচনে প্রতিবারই বিজয়ের নতুন স্টাইল চর্চা করছেন শেখ হাসিনা। আগামী ৭ জানুয়ারি হয়ত শেখ হাসিনার বিজয়ের তরিকার আরো একটি নতুন স্টাইল দেখবে বিশ্ববাসী। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা দেখেই অনুমান করা যায়, শেখ হাসিনা আরো একটি নয়া কিসিমের বিজয়ের তরিকা আবিষ্কার করেছেন। এখন শুধু কাজী হাবিবুল আওয়ালের প্রযোজনায় জনগণকে দেখানো হবে ৭ জানুয়ারী। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, বিচারালয় ও প্রশাসনকে কব্জায় নিয়ে দেশের মানুষকে কিভাবে জিম্মি করতে হয় সেটার একটি বাস্তব চিত্র দেখা যায় এখন বাংলাদেশে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী মডেল থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মডেলটি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী আরো একটু ভিন্ন কিসিমের নির্বাচন দেখবে দেশের মানুষ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী ভোটের আগেই ২৫৪জনকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল রাকিব কমিশন। কারণ, এসব আসনে শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে কেউ নির্বাচন করতে আসেনি। মূল কারণটি ছিল মানুষ এই একতরফা নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভোটের দিন দেখা গিয়েছিল কেন্দ্রে মানুষ যায়নি। ভোটের দিন কেন্দ্রে ছাগল-কুকুরের বিচরণ আওয়ামী গণমাধ্যম গুলোতেই প্রকাশিত হয়েছিল তখন।
২০১৪ স্টাইলে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তৎকালীন জাতীয় পার্টির প্রধান মরহুম হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ একতরফা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই ক্ষ্যাপে গিয়ে শেখ হাসিনার অনুগত সেনা গোয়েন্দা প্রধানের নেতৃত্বে এরশাদের উপর চড়াও হয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুস্থ এরশাদকে অসুস্থ বানিয়ে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়েছিল তখন। সিএমএইচ থেকেই তিনি মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু প্রার্থী প্রত্যাহারের পরও ঢাকার গুলশান এলাকা নিয়ে গঠিত আসনে ৫ জানুয়ারী এরশাদকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল রকিব কমিশন। প্রার্থীতা প্রত্যাহরণের পর ভোটের দিন বিজয়ী ঘোষণা করার মত ঘটনা দুনিয়ার আর কোন দেশে ঘটেছিল কারো জানা নেই। তবে এরশাদ রকিব কমিশনের ঘোষিত ফলাফল মেনে নিয়ে আবার বিরোধী দলের আসনেও বসেছিলেন তখন। তাঁর জীবদ্দশাতেই স্ত্রী রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহযোগী জাতীয় পার্টি, হাসানুল হক ইনুর জাসদ, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন দলকে কিছু আসনে মনোনীত করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরকম অনেক বিচিত্র ঘটনার মাধ্যমে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী রকিব মার্কা নির্বাচনে গঠিত একটি সংসদ দিব্বি ৫ বছর স্থায়ী হয়েছিল। বিরোধী দলের লিপ সার্ভিস প্রতিবাদ ছাড়া দেশের মানুষ দৃশ্যত আর কোন কর্মসূচি তখন দেখেনি। এমন কি শেখ হাসিনার সাজানো এই সংসদের মাধ্যম গঠিত সরকারের অধীনে সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
অত্যন্ত নির্বিঘ্নে ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয় শেখ হাসিনার মনোনীত নির্বাচন কমিশন। এটা হুদা কমিশন হিসাবে পরিচিত। তামাশার সার্চ কমিটি গঠন করে খুঁজে বের করা হয় নুরুল হুদাকে। তাঁর মাধ্যমেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পার করা হয়। ওই নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ভুয়া মামলায় কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে নিতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, পরিকল্পিতভাবে কারাদণ্ড হাইকোর্টে দ্বিগুণ করা হয়। তারপরও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গঠন করে সংলাপের মাধ্যমে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় সব বিরোধী দল। এই নির্বাচনে পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা মিলে ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে সীল দিয়ে বিজয় নিশ্চিত করে রাখে। এই নির্বাচনেও শেখ হাসিনা কিছু আসনে তাঁর ফ্যাসিবাদের সহযোগী জাতীয় পার্টি, ইনুর জাসদ, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং তরিকত ফেডারেশনকে মনোনীত করেন। রওশন এরশাদকে আবারো বিরোধী দলের নেতা বানানো হয়। এরকম অদ্ভুত কিসিমের ভোট ও সরকার দুনিয়ার আর কোন দেশের গঠিত হয়েছিল কি না কখনো সেটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এবার চতুর্থ মেয়াদের জন্য শেখ হাসিনা নিজের অধীনে তৃতীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। এই নির্বাচনে ইতোমধ্যে আজ (২৬ নভেম্বর) তাঁর দলের মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহযোগী অন্য কোন দলের জন্য এবার আসন ফাঁকা রাখা হয়নি। এবার তিনি বিশ্ব বাসীকে দেখানোর চেষ্টা করবেন দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ও তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। এখানে তাঁর দিক থেকে মনোনীত করে বিজয়ী করার কোন ঘটনা নেই। সেই ফর্মুলার অংশ হিসাবেই ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা নির্ধারণ করেছিলেন কতটি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে জাতীয় পার্টি। কোন কোন আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিবে সেটাও ঠিক করে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
জাতীয় পার্টি শুধু নয়, রাশেদ খান মেননকে ঢাকার একটি আসনে গত ২টি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন শেখ হাসিনা। মেননের অনুসারীক আরো একাধিক আসনে নৌকা দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সাল থেকে। একই অবস্থা ছিল হাসানুল হক ইনুর। তরিকত ফেডারেশনও নৌকা নিয়েই বিজয়ী হয়েছিল। এবার তাদের দলের প্রতীক দেওয়া হচ্ছে না। কোন কায়দায় শেখ হাসিনা তাঁর ফ্যাসিবাদি রাজনীতির সহযোগীদের সংসদে জায়গা দিবেন সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদেরকে এবার নিজ দলের প্রতীকে ভোটে বিজয়ী করে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্ববাসীকে দেখানো হবে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সকলে বিজয়ী হয়েছেন। যদিও শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কারো বিজয় পাওয়া সম্ভব হবে না। ভিন্ন কায়দায় ফ্যাসিবাদ সহযোগীদের বিজয়ী করে প্রমাণের চেষ্টা করা হবে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমুলক ছিল। তাদের মানুষ ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে।
ফ্যাসিবাদ সহযোগী নির্বাচন কমিশনের মধ্যে রকিব কমিশন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪জনকে বিজয়ী করে রেকর্ড গড়েছেন। হুদা কমিশন রাতের আধারে ব্যালটে সীল দিয়ে কিভাবে শেখ হাসিনার পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে হয় সেটা প্রমান করে গেছেন। কাজী হাবিবুল আওয়াল কমিশনের মাধ্যমে পিক অ্যান্ড চুজ করা হবে ভোটের দিনে ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক