- অপূর্বানন্দ
- ১১ জুন ২০২২, ২০:৩৬, আপডেট: ১২ জুন ২০২২, ০৫:৪০
ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কয়েক দিন ধরে বেকায়দায় পড়েছে। দলটির দুই উচ্চপদস্থ নেতা, একজন পার্টির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা এবং অন্যজন দিল্লির গণমাধ্যম ইউনিটের প্রধান নবীন কুমার জিন্দাল প্রকাশ্যে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করার পর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঝড়ে পড়েছে বিজেপি।
শুক্রবার আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে উত্তরপ্রদেশের কানপুর শহরে হাজারো মুসলমান রাস্তায় নেমে আসেন। উত্তেজনা প্রশমন এবং দায়ীদের ভারতের ঘৃণাত্মক বক্তৃতা আইনের আওতায় শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ সহিংসতার মাধ্যমে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পুলিশ রাজ্যের কঠোর ‘গ্যাংস্টার আইনের’ আওতায় প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। এমনকি তাদের দম্পত্তি ‘জব্দ ও ধ্বংস’ করার হুমকি দিয়েছে।
মহানবী সা:-এর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের দমনমূলক ও গর্হিত পদক্ষেপের খবর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ার পর কাতারসহ কমপক্ষে পাঁচটি আরব দেশ ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কয়েকটি আরব দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও কুয়েতের কিছু দোকানপাট থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদের বোধগম্য ক্ষোভ নয়; বরং মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ার হুমকি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষতি সীমিত করার জন্য একটি অভিযান শুরু করতে বাধ্য করেছে।
কূটনৈতিক প্রতিবাদের পর সরকার শিগগির এ ঘোষণা দেয় যে, অভিযুক্ত শর্মার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। জিন্দালকে পার্টির সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিজেপিও একটি সাধারণ বিবৃতি দিয়ে বলেছে : ‘দল যেকোনো ধর্মের যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অপমান করার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।’ এ দিকে কাতারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল বলেছেন, পার্টির মধ্যকার কিছু ‘প্রান্তিক ব্যক্তি’ এই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তাদের এই মন্তব্য ভারত সরকারের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না। মহানবী সা:-এর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যকারী কর্মীদের ‘সাময়িক বরখাস্ত’ এবং ‘বহিষ্কার’ করার পদক্ষেপ এবং তাদের মন্তব্য থেকে সরকারকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা সঙ্গত কারণে ভারতের ভেতরের বা বাইরের কাউকে সন্তুষ্ট করেনি।
প্রথমত, শর্মা এবং জিন্দালকে পার্টির অভ্যন্তরে ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ তথা প্রান্তিক ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। কারণ ঘটনার আগে উভয়ই বিজেপির উচ্চপদস্থ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারা যে পদমর্যাদায় ছিলেন ওই পদগুলোর মাধ্যমে তাদের দল পরিচালনার ব্যাপারে বক্তব্য রাখার এবং দেশের জনগণকে দলটির নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জানানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটা যুক্তি দেয়া কঠিন যে, তাদের ইসলামফোবিক তথা ইসলাম বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ভারত সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ ইস্যুটির ব্যাপারে বিজেপির কোনো নেতাই দৃঢ়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। দলটির ইসলামবিদ্বেষী নীতি, কার্যক্রম এবং বিবৃতিগুলো ইতোমধ্যে ভালোভাবে নথিবদ্ধ রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, বিজেপি পরিচালনার নীতিকৌশলের সদাসর্বদা অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষ।
এটা কোনো দূর অতীতের বিষয় নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের দূরবর্তী ইতিহাসের মুসলিম ব্যক্তিত্বদের এবং বর্তমান সময়ের ‘সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় চরমপন্থা’র মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। প্রকাশ্য দু’টি বক্তৃতায় তিনি তিরস্কার করেন, ভারতের মুসলমানদের তাদের পূর্বপুরুষের দ্বারা সংঘটিত কথিত অপরাধের জন্য দায়ী করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। তিনি এসব অশালীন ও নির্লজ্জ মন্তব্যের জন্য দলের পক্ষ থেকে কোনো ধাক্কা খাননি।
উত্তরপ্রদেশের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও গত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের সময় মুসলিমবিরোধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আসামের বিজেপি-সংশ্লিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্বাস শর্মা তার বক্তৃতায় আরো নির্লজ্জ ছিলেন। গত বছর তিনি আসামে জোরপূর্বক উচ্ছেদ অভিযানের সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা একজন নাবালকসহ দুই মুসলমানের হত্যাকে অতীতের হিন্দুদের ‘শহীদ হওয়ার’ ‘প্রতিশোধের একটি কাজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বিজেপির শাসনামলে সারা দেশের মসজিদ ও মুসলমানদের কাছে পবিত্র অন্যান্য স্থানগুলো হিন্দুদের কাছে হস্তান্তর নিশ্চিত করতে একাধিক প্রচার অভিযান শুরু করা হয়েছে। তাদের দাবি এ স্থানগুলো মূলত ছিল হিন্দুদের। গুজরাট থেকে দিল্লি পর্যন্ত রাজ্যগুলোতে জাফরান স্কার্ফ পরা হিন্দু পুরুষরা এবং কিছু ক্ষেত্রে লাঠি বহন করে এবং তলোয়ার নিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও মসজিদের বাইরে গণহত্যার হুমকি সম্বলিত উসকানিমূলক গান বাজানো হয়েছে এবং ঘৃণ্য স্লোগান দেয়া হয়েছে। বিজেপি এই উসকানিদাতাদের কেবল শাস্তি দিতে অস্বীকারই করেনি উল্টো মুসলমানদের নিজেদের রক্ষা করা প্রতিরোধ করতে ভারতীয় রাষ্ট্রের সব শক্তি ব্যবহার করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, এসব লোকের এই উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেসব মুসলিম দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
মাঝে মাঝে এবং নিয়মিতভাবে ইসলামফোবিক মন্তব্য করা এবং তাদের সমর্থকদের হিংসাত্মক ইসলামফোবিয়াকে সমর্থন করার বাইরে বিজেপি নেতারাও গত কয়ক বছরে অসংখ্য ইসলামফোবিক এবং বৈষম্যমূলক নীতি ও আইন পাস করেছে।
তিন তালাক বা তাৎক্ষণিক তালাককে অপরাধমূলক হিসেবে বিবেচনা করে আইন করা, গরু জবাই নিষিদ্ধ করা, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার নামে ধর্মান্তরকরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে নিষিদ্ধ করা। গো হত্যা, মুসলিম পুরুষ ও হিন্দু মহিলাদের মিলন তথা বিয়েকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং সারা দেশে প্রকৃতপক্ষে গোশত খাওয়া ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার নির্বাহী আদেশগুলো হলো বিজেপির শাসনামলে কার্যকর ইসলামফোবিক নীতিগুলোর কয়েকটির উদাহরণ।
অবশ্যই, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনও (সিএএ) রয়েছে। সেটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্বাসকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের একটি ভিত্তি করে দিয়েছে এটি। বিজেপি সরকার শুধু এই ইসলামবিরোধী আইনই পাস করেনি; বরং এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী মুসলিমদের টার্গেট করতেও বিজেপি সমর্থকদের অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবাদকারীদের লেলিয়ে দিয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছে তাতে যেসব বিজেপি নেতা আরো ইন্ধন দিয়ে পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছিল। পার্টির পক্ষ থেকে তাদের কোনো তিরস্কার করা হয়নি। অথচ এ-সংক্রান্ত সহিংসতায় শত শত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে।
এই সবকিছুর আলোকে বিজেপি সরকার এখন যে, শর্মা ও জিন্দালের উসকানিমূলক মন্তব্য দলের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না বলে দাবি করছে- তা গভীরভাবে অসত্য। এই মন্তব্যগুলো শাসক দলের মধ্যে কিছু প্রান্তিক বা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির বা কিছু নিম্নপদস্থ কর্মীদের ভুল পদক্ষেপ নয়; বরং মুসলিম ও ইসলামের প্রতি বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভাবের সঠিক প্রতিফলন।
সর্বশেষ বিতর্ক সম্পর্কে জারি করা এক বিবৃতিতে সৌদি আরবভিত্তিক ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এ বাস্তবতা সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ওআইসি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে কেবল বিজেপি কর্মীদের আপত্তিকর মন্তব্যের নিন্দাই করেনি; বরং জোর দিয়ে উল্লেখ করেছে, তারা ভারতে ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার প্রেক্ষপটে ক্ষমতায় এসেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে এসব অপকর্মের অনুশীলন করে যাচ্ছে।
ওআইসির বিবৃতিটি সুস্পষ্টভাবে তাদের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত হেনেছে- তাই ভারত সরকার দ্রুততার সাথে তীব্রভাবে এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ওআইসির সমালোচনাকে অযৌক্তিক এবং সঙ্কীর্ণ মনের অভিব্যক্তি বলে অভিহিত করেছে। এটি দুঃখজনক যে, ওআইসি সচিবালয় আবারো উদ্দেশ্যমূলক, বিভ্রান্তিকর ও দুষ্টু মন্তব্য করেছে। এতে কেবল বিভাজনমূলক এজেন্ডা উন্মোচিত হয়েছে- যার মাধ্যমে কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করা যায়। সরকার ওআইসির বিবৃতির ব্যাপারে কট্টরভাবে জবাব দিয়েছে কারণ ওআইসি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে বিজেপির শাসনাধীনে ভারত একটি ইসলামবিদ্বেষী দেশ হয়ে উঠেছে, সেখানে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ এবং তাদের অপমান ও অবমাননা করা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেখানে বিশ্ব ভারতের সর্বশেষ ইসলামবিদ্বেষী বিতর্কের ব্যাখ্যার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেখানে অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে এবং বিজেপির গল্পটি বলা উচিত নয় যে, আপত্তিকর মন্তব্যগুলো কিছু বিপথগামী ব্যক্তির নিছক মানসিক বিস্ফোরণ ছিল, যাদের মতামত শাসকদলের প্রতিনিধিত্ব করে না।
লেখক : দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দির শিক্ষক
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
আলজাজিরার সৌজন্যে