জনপ্রিয়তা যেমন বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায়, কখনও কখনও তা বিড়ম্বনায়ও ফেলে। তেমনি জনপ্রিয়হীনতা কখনও কখনও খ্যাতিকে কলঙ্কিত করে তোলে। জনবিমুখতার সঙ্গ দিতে গিয়ে ভুল করে ফেলেন অনেকে। তাই ক্রিকেটে নন্দিত হয়েও ব্যক্তি সাকিব আল হাসান নিন্দিত। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার সমালোচিত করেছে তাঁর সামগ্রিক সত্তাকেই। ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে যে সাকিব হতে পারতেন নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শিক একজন, সেই তিনিই কিনা ক্রিকেটের বাইরের ভ্রান্তজীবনে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন।
হোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে কাঁকড়ার খামার, অর্থের বিনিময়ে যে কোনো শোরুম উদ্বোধন থেকে কলকাতায় পূজামণ্ডপে গিয়ে প্রদীপ জ্বালানো, শেয়ারবাজারে কারসাজি, মিরপুরের গ্যালারিতে দর্শকের গায়ে হাত; সমর্থকদের মধ্যে রূঢ় সাকিবকে নিয়ে একটা অস্বস্তি ছিলই। তার পরও বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয়কে তাঁর ক্রিকেটীয় অবদানের কারণেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন অনেকে। ফিক্সিংকাণ্ডে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছেন ভক্তকুল। কিন্তু সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় তাঁর নীরব ভূমিকা কষ্ট দিয়েছে, ছাত্র-জনতার রক্তও তাঁর বিবেককে নাড়া দিতে পারেনি। যারা নিহত হয়েছেন, হয়তো তাদের অনেকেই সাকিবের নাম ধরে গ্যালারিতে উল্লাস করতেন, তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন।
সাকিব তাঁর রাজনৈতিক সত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি, বিসর্জন দিতে হয়েছে তাঁর ক্রিকেটীয় সত্তাকেও। বিদায় বলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক টি২০ ও টেস্টকে। তিনি চেয়েছিলেন মিরপুরে আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলে টেস্ট থেকে অবসর নিতে। দেশে ফেরার নয়, নিরাপত্তা চেয়েছিলেন দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার। বিসিবি সেই আশ্বাস দিতে পারেনি তাঁকে। গত দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে যে নামটি মিশে ছিল, তা হয়তো মুছে যাবে কানপুর থেকেই। সাকিবের পরিণতি হয়তো উদাহরণ হয়ে থাকবে, একই সঙ্গে ক্রিকেট আর রাজনীতি যে হতে পারে না, সেটাও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। ব্যক্তি সাকিবের এই নিন্দিতরূপ যেমন সত্য, তেমনই মিথ্যা নয় ক্রিকেটার সাকিবের নন্দিত রূপটিও।
ওয়ানডে ক্রিকেটে টানা ১৭৩৯ দিন (৭ মে ২০১৯ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) এক নম্বর অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। তাঁর মতো এত লম্বা সময় আইসিসির এই অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ছিলেন না আর কেউ। সাকিবের এই অনন্য স্বীকৃতি অস্বীকার করার নেই। ২০০৭ সালে অভিষেকের পর থেকে তাঁর অগ্রগামী যাত্রায় গর্বিত হয়েছিল পুরো দেশ। ২০০৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গিয়ে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দও ভাগাভাগি করে নিয়েছিল সবাই। ২২ বছর ১১৫ দিন বয়সী সাকিব টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক (সেই সময়ের রেকর্ড) হিসেবে নিজেকে চিনিয়েছিলেন বিশ্বক্রিকেটের সামনে। ২২৭ ওডিআই খেলে দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বাধিক সিরিজ সেরাও হয়েছিলেন তিনি। ওয়ানডেতে একই ভেন্যুতে (মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম) সর্বাধিক ১৩১ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডও তাঁরই দখলে। মিরপুরের উঠান তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল, সেখানে বল হাতেই জাদু ছড়াতেন। এই মাঠেই তিন ফরম্যাটে ২৫২ উইকেট শিকার করা আছে তাঁর– এটাও কোনো এক ভেন্যুতে কোনো ক্রিকেটারের সর্বাধিক শিকারের রেকর্ড। এই মাঠে ওয়ানডেতে মোট ২৬৫৬ রানও রয়েছে তাঁর।
আসলে ঘরের মাঠকে দুর্গ করার ব্যাপারটি সাকিব-তামিমদের সময় থেকেই শুরু। ২০১০ সালের অক্টোবরে ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডকে ৪-০তে সিরিজ হারায় বাংলাদেশ। ২১৩ রান করে সিরিজ সেরা হয়েছিলেন সেবার সাকিব। মিরপুরে জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড বাদেও যে বড় দলগুলোকে হারানো যায়, সেই বিশ্বাসটা তখন থেকেই গেথে গিয়েছিল সবার হৃদয়ে। লিলিপুটের দেশে গালিভারের মতোই তখন আবির্ভূত হয়েছিলেন সাকিব। আনন্দ দিয়ে গেছেন মাঠে, সমর্থকদের মধ্যেও ‘যে কোনো দলকে হারানোর’ বিশ্বাসও দিয়ে গেছেন। ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারার পর মুশফিকের কাঁধে মুখ রেখে তাঁর কান্নার দৃশ্য কি সহজেই ভুলতে পারবে একটি প্রজন্ম।
যখন তিনি দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসেন, তখনও তাঁর মধ্যে লাল-সবুজের আবেগই খুঁজে পেয়েছেন সমর্থকরা। অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে, তখনও দলের অন্যতম পারফরমার ছিলেন সাকিব। পরের বিশ্বকাপেও ৬০৬ রান করা সাকিব ছিলেন রোহিত ও ওয়ার্নারের পরের স্থানেই। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৪৪৬ ম্যাচে তাঁর ১৪ হাজার ৭২১ রান ও ৭০৮ উইকেট; যে কোনো দেশের যে কোনো ক্রিকেটারের জন্যই এই পরিসংখ্যান ঈর্ষণীয়। ক্যারিয়ারে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো সব দলের বিপক্ষেই দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জিতেছেন।
হয়তো দেশের হয়ে আইসিসি বা এসিসির কোনো টুর্নামেন্টে দলীয়ভাবে কোনো ট্রফি জিততে পারেননি, তবে ব্যক্তিগত অর্জনের পূর্ণতার তৃপ্তি তাঁর রয়েছে বটে, আক্ষেপও কম নেই। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জীবনে চোট আঘাতের মতো স্বাভাবিক ঘটনা তাঁরও রয়েছে। তবে সম্প্রতি চোখের সমস্যা ও আঙুলের চোট হয়তো বছর সাঁইত্রিশের সাকিবকে কিছুটা দুর্বলও করে দিয়েছিল। গত এক বছরে মাত্র চারটি টেস্ট খেলে ১৪৬ রান করেছিলেন তিনি, ১২ টি২০ খেলে রান পেয়েছিলেন মাত্র ১৬৯।
এমনিতে পারফরম্যান্সে ভাটার টান, তার সঙ্গে হত্যা মামলা, শেয়ারবাজারের কারসাজিতে জরিমানা; সব মিলিয়ে মানসিকভাবে তিনি যে বিধ্বস্ত, সেটা তিনি নিজেই বলেছেন। তাই তাঁর এই প্রস্থানকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন কাছের লোকেরা। ‘আমার মনে হয়, সাকিব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কারণ সে একজন মানুষ, খেলা উপভোগ না করলে খেলবে না। আমার কাছে মনে হয়েছে, সে খেলাটা উপভোগ করছে না। কেউ সাকিবকে নিয়ে প্রশ্ন করবে– খেলবে কি খেলবে না, সেটা তার কাছে একধরনের অপমানজনক।’
এমনটাই মনে করেন কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। আকরাম খানের মতো সাবেক ক্রিকেটাররাও মনে করেন যা করেছেন ঠিকই করেছেন সাকিব। ‘বিশ্বের অনেক বড় একজন ক্রিকেটার সাকিব। তাকে সম্মান করি। দেশের জন্য সে অনেক কিছু করেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে স্বীকৃত সেরা অলরাউন্ডার সে। তার মতো আর কেউ আসবে কিনা, বলতে পারছি না। বাংলাদেশ তার সার্ভিস মিস করবে। বাস্তবতা হলো, একদিন সবাইকে খেলা ছাড়তে হয়। সে হয়তো সঠিক সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
সাকিবের ইচ্ছা, তিনি পরের বছরের শুরুতে পাকিস্তানের মাঠে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলবেন এবং সেটাই হবে তার দেশের হয়ে শেষ টুর্নামেন্ট ও ম্যাচ। তবে সময়ই বলে দেবে সব। ওই যে ‘টাইমড আউট’– মনে আছে, গত বিশ্বকাপে হেলমেটের ছেঁড়া ফিতার জন্য ব্যাটিংয়ে নামতে দেরি করে ফেলেছিলেন শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ। সাকিব তাঁকে ঘড়ি দেখিয়ে টাইমড আউট করে দিয়েছিলেন। নন্দিত-নিন্দিত সাকিব এবার বোধ হয় নিজেই সেই টাইমড আউটে পড়ে গেলেন।
samakal