মার্কিন মুলুকের সরকারের গভীরের সরকার [Deep State] ট্রাম্পের পাগলামি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আগামী বছর ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট রূপে শপথ নিচ্ছেন। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, গত মাসের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারত এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণি মনেপ্রাণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। চার বছরের শাসনামলে ট্রাম্প একনায়কদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা দেখিয়েছেন। সৌদি আরবের যুবরাজ এমবিএস, আমিরাতের ইহুদীপন্থী যুবরাজ এমবিজেড এবং ইসরায়েলের কট্টর যিয়নবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানইয়াহু ট্রাম্পের প্রভাবশালী ইহুদী জামাতা জারেড কুশনারের তিন অন্তরঙ্গ বন্ধু। ট্রাম্প নিজেও উত্তর কোরিয়ার কিম ইল জং এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের প্রকাশ্য গুণগ্রাহী। দক্ষিণ এশিয়ায় গুজরাটের কসাই নামে পরিচিত ভারতের চরম ইসলামবিদ্বেষী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথেও ট্রাম্পের বেশ গাঢ় সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। একে অপরের ভাষা না বুঝলেও, গত এক বছরের মধ্যে মোদী যেমন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ইন্ডিয়ান আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের পক্ষে পরোক্ষ প্রচার চালিয়েছেন, ট্রাম্পও প্রতিদানে ভারতে এসে মোদীর অবস্থান দৃঢ় করেছেন। ট্রাম্পের ভারত সফরকালিন দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দু চরমপন্থিরা সংখ্যালঘু মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও তিনি সেদিকে ফিরেও তাকান নাই।
বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার সাথে ট্রাম্পের কোন আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ না ঘটলেও দেশটির ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কখনও উচ্চবাচ্য করেন নাই। ঢাকা সামলানোর দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুরোপুরি দিল্লীর হাতেই ছেড়ে রেখেছিলেন। শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে এমন ব্ল্যাঙ্ক চেক উপভোগ করেছেন যে, দলীয় গুণ্ডাদের দিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পিটুনি দিতেও তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নাই। দিল্লীর ওকালতিতে হাসিনার কিল খেয়ে কিল হজম করেছে পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্য কোন মুসলিম প্রধান দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হলে ওয়াশিংটন অবশ্যই যুদ্ধ বাধিয়ে দিত।
আজকের লেখার এ পর্যায়ে বুদ্ধিমান এবং রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন এমন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মোড়লি একমাত্র ট্রাম্প জামানাতেই গড়ে ওঠে নাই। এর বেশ দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীরা ১৯৯০’র দশকে ‘সভ্যতার সংঘাতের’ [Clash of civilizations] তত্ত্ব হাজির করেন। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী তথাকথিত খ্রিষ্টান ও ইহুদী [Judeo-Christian] সভ্যতার মূল শত্রু রূপে ইসলাম এবং চীনের কনফুসিয়ান সভ্যতাকে চিহ্নিত করা হয়। নিউ ইয়র্কে নয় এগারোর রহস্যজনক ও বিস্ময়কর বিমান হামলার পর সভ্যতার সংঘাতের তত্ত্ব ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের ভূরাজনৈতিক কৌশলের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট বুশ বিশ্বকে ‘আমাদের’ এবং ‘তোমাদের’ মধ্যে ভাগ করে তাবৎ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম এবং চীনের প্রভাব মোকাবেলায় হিন্দু ভারতকে একমাত্র কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণের বিষয়ে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংঘাতময় বিশ্ব পরিস্থিতির সুযোগে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আধিপত্যবাদী নীতি অনুসরণকারী ভারতের দক্ষিণ এশিয়ায় একচেটিয়া মোড়লিপনা করার অভিলাষ অনেকাংশে পূর্ণতা লাভ করে। এই কারণেই রিপাবলিকান ও শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র দিল্লীর তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে প্রথমে কোলে উঠিয়ে নিলেও পরবর্তী ডেমোক্রেট ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামা সেই সরকারকেই কোল থেকে না নামিয়ে বরং মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। ওবামার সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীতেও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং এর ভূয়সী প্রশংসা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনকালেই কট্টর সাম্প্রদায়িক এবং প্রকাশ্য হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসে। ওবামা তার লেখায় বিজেপির চরমপন্থি রাজনীতির সমালোচনা করলেও কংগ্রেসের বিদায়ের পরও দিল্লি-ওয়াশিংটন কৌশলগত মৈত্রীর কোন হেরফের হয় নাই। বরং ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের সেক্রেটারি অব স্টেট, জন কেরি ভারতের সাথে সামরিক চুক্তি পর্যন্ত সই করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জো বাইডেন সরকারেও জন কেরি সেক্রেটারি অব স্টেট না হলেও, গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে যাচ্ছেন। সুতরাং, ট্রাম্প পূর্বের ধারাবাহিকতাতেই তার চার বছরের মেয়াদে ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলমান মৈত্রীকে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন মাত্র।
বিগত দুই দশকের উপরোক্ত ইতিহাস নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করে আমরা তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির মৌলিক পরিবর্তনের কতটুকু আশা করতে পারি? ইসলাম এবং চীনের সাথে সভ্যতার দ্বন্দ্বের যে তত্ত্ব ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রহণ করেছেন সেখান থেকে তাদের অদূর ভবিষ্যতেও সরে আসার কল্পনা আমি অন্তত করি না। সেই মূল জায়গাতে পরিবর্তন ঘটার কোন সম্ভাবনা নাই। ট্রাম্পের পরাজয়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেখতে উদগ্রীব রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীদের লেখা এবং বক্তব্যে যে সকল আশার বাণী পড়তে পারছি এবং শুনতে পাচ্ছি তার সংগে সহমত হতে পারলাম না বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইউটিউবে নতুন তারকাদের ‘হাসিনার দিন শেষ’ জাতীয় বালখিল্য বাগাড়ম্বরে আমি যুগপৎ কৌতুক এবং বিরক্ত বোধ করি। তাহলে কি ট্রাম্পের বিদায়ে দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কিত মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে আদৌ কোন পরিবর্তন হবে না? আমি মোটেও এ কথা বলছি না। আশার পারদ নীচে নামিয়ে কিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা আমিও দেখি। আমার যৎসামান্য জ্ঞান ও ক্ষুদ্র বুদ্ধি অনুযায়ী বাস্তবসম্মত প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে আজকের লেখা শেষ করবো।
জো বাইডেনের সেক্রেটারি অব ষ্টেট, পেশাগত কূটনীতিক অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইহুদী পরিবারের সন্তান। তার দীর্ঘ কূটনৈতিক পেশাগত জীবনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হচ্ছে যে তিনি মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে মনে করেন। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসন দিল্লী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শেখ হাসিনার তাবৎ অপকর্মের ঘটনায় যেভাবে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই বাংলাদেশী একনায়কতোষণ নীতি থেকে সরে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসকের ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ নিয়ন্ত্রণের নামে জনগণের ওপর অবাধে নিপীড়ন চালানোর মার্কিন ব্ল্যাঙ্ক চেকটি তামাদি হয়ে যেতে পারে। জঙ্গি কার্ডও হয়তো আর চলবে না। ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ লগ্নে মার্কিন সিনেট র্যাব ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞার যে দ্বিদলীয় আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে রেখেছে তার বাস্তবায়ন হয়তো আমরা সংগত কারণেই আশা করতে পারি। আর নিষেধাজ্ঞা একবার শুরু হলে একসময় স্বয়ং শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদেরও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞার বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সকল কর্মকর্তা রয়ে যাবেন তারাও হাসিনার নির্দেশে গুমখুন কিংবা বিচার বহির্ভূত হত্যা চালিয়ে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন। তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একবার নিষেধাজ্ঞা দিলে জাতিসংঘের ভাড়াটে সৈন্যের চাকরী মেলাও কঠিন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাহস অন্তত খানিকটা হলেও বাড়া উচিত।
গত এক যুগে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে ফেলেছেন। দিল্লীর কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া সেনাবাহিনী ও দলবাজ পুলিশের মদদে ২০১৪ সালের একদলীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের পূর্ব রাতের নির্বাচন করেও সহজেই তিনি পার পেয়ে গেছেন। অন্তরাল থেকে কাজ করে দিল্লী ঢাকার স্বৈরশাসকের জন্য আন্তর্জাতিক বৈধতাও জোগার করে দিয়েছে। ট্রাম্প সরে যাওয়ায় নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনার নির্লজ্জ তামাশার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়বে বলেই আমি মনে করি। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি নিশ্চিতভাবেই এবার মার্কিন সরকারের চাপের মুখে পড়বেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনী তামাশা এবং পরবর্তী অর্থহীন উপনির্বাচনগুলোয় অংশগ্রহণ না করলে শেখ হাসিনার ওপর চাপের তীব্রতা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেত। যাই হোক, সেই ভুলের মাশুল তারাই দেবে। তবে, এখনও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে পারলে আমি আশাবাদি যে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের যৌক্তিক দাবিকে নতুন মার্কিন প্রশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই সমর্থন করবে।
ওয়াশিংটনকে বাগে আনতে হলে শেখ হাসিনাকে আবারও সেখানকার ভারতীয় লবির ওপর নির্ভর করতে হবে। এখন প্রশ্ন হোল, ট্রাম্পকে অনেকটা প্রকাশ্যে সমর্থন জানানোর পর মোদী সরকারের অধীনে ভারতীয় লবি কি বাইডেন প্রশাসনে আগের মতই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে? নাকি নতুন প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির পুনর্মূল্যায়ন করবে? তারা কি অনুধাবন করতে সক্ষম হবে যে বাংলাদেশকে দিল্লীর হাতে সমর্পণের মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি ব্যর্থ হয়েছে? এই ভ্রান্ত নীতির ফলে ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছে। বরং চীনের প্রভাব বাংলাদেশে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলংকাতেও চীন ক্রমাগতভাবে ভারতকে কোণঠাসা করছে। তদুপরি নরেন্দ্র মোদীর অধীনে ভারত ক্রমান্বয়ে একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের মুখোশের অন্তরালে ভারতে বিগত দুই দশকে ক্রমেই হিটলারের নাৎসি পার্টির মত এক ফ্যাসিস্ট শক্তি এত প্রবলভাবে যে বিকশিত হয়েছে তার পেছনে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত ওয়াশিংটনের অন্ধ সমর্থন অনেকটাই দায়ী। সুতরাং, সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই জরুরী হয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটনে এতটুকু ঘটলেই আমাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। বিদেশী কোন রাষ্ট্রের কাছে বাস্তবতাবিবর্জিত অলীক প্রত্যাশা ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াইকে বরং ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন দেশের মানুষকেই ঘটাতে হবে।