ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিনিয়োগকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে নিয়ে আসা অর্থসংক্রান্ত জরিপের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহের পরিসংখ্যান ও গতিপ্রকৃতির তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে নতুন বিদেশী মূলধন (ইকুইটি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট), আয়ের পুনর্বিনিয়োগ (রিইনভেস্টেড আর্নিংস) ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন) এ তিন ভাগে এফডিআই প্রবাহ হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ ছিল ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ দাঁড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারে। এ হিসেবে নতুন বিদেশী মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
২০২১ সালের জুন শেষে দেশে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭০ কোটি ২৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। ওই বছরের ডিসেম্বর শেষে যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। ২০২২ সালের জুন শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ হয় ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে যার পরিমাণ হয়েছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এক বছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিট এফডিআইয়ের ইকুইটি ক্যাপিটাল হলো নতুন মূলধন। এ অর্থপ্রবাহ নির্দেশ করে যে দেশে বিদ্যমান বা নতুন বিনিয়োগকারীরা বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে নতুন মূলধন কতটা নিয়ে আসছেন। হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ কমেছে অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগ আসছে না। মোটাদাগে বলা যায়, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। এ পরিসংখ্যান আরো নির্দেশ করে যে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো এখনো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইকুইটি ক্যাপিটাল হ্রাস পাওয়া খুবই খারাপ ইন্ডিকেশন। ইকুইটি যেটা নতুনভাবে আসে সেটাকে গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট বলে, এ ধরনের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। যেটুকু হচ্ছে সেটা অন্যভাবে আসছে। নতুনভাবে আমরা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাচ্ছি, অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগকারী, নতুন দেশ থেকে এসব ক্ষেত্রে কেউ উৎসাহ দেখাচ্ছে না। আমরা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, আমাদের আশা ছিল এগুলোয় অন্তত নিষ্কণ্টক জমিসংক্রান্ত যে বড় বাধা, সেটা দূর করা গেছে। কিন্তু ওয়ান স্টপ সার্ভিসসহ মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ এসব সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না। এজন্য চিত্রটি খুবই নেতিবাচক। ইকুইটি ক্যাপিটাল এলে আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টটা আরেকটু শক্তিশালী হতে পারত। কারণ ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) প্রধান ইস্যু হয়ে গেছে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট।’
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞের পরও সেখানে বিদেশী বিনিয়োগ যে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না, তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। গত অর্থবছরে দেশে আসা নিট এফডিআই প্রবাহের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশই এসেছে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ ও অর্থনৈতিক অঞ্চলবহির্ভূত এলাকায়। গত অর্থবছর বেজায় নিট এফডিআই ছিল মাত্র ৪১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। আর রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ডলারের।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা চিন্তা করলে দুদিন আগেও থাইল্যান্ড থেকে ২ মিলিয়ন ডলার এফডিআই আমরা পেয়েছি। বেজায় মোট বিনিয়োগ হয়েছে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন। আর বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের। বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোয় এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থান ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে বেজার যে তথ্য দেয় সেটা ভুল। আমাদের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে তাদের বলা হয়েছে এ তথ্য সংশোধন করতে। সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার এবং সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে সহায়তা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।’
বেজা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সফলতার কথা জানালেও দেশে বিনিয়োগের পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সংশ্লিষ্টরা ভিন্ন বাস্তবতার কথা জানাচ্ছেন। তাদের মতে, গত বছর দেশে বেশকিছু বিদেশী বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। অনেকগুলো দলও এসেছে। একাধিক বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছে। এভাবে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না বা মাঠপর্যায়ে কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
বিডার নির্বাহী সদস্য (স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট) অতিরিক্ত সচিব অভিজিত চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন বিনিয়োগ না আসার প্রথম কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ডলার সংকট। সেটার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে বিদেশ থেকে দল আসছে কিন্তু বাস্তবায়নে এখনো আসেনি। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় বিষয়। বিশেষ করে আমাদের গত এক-দুই মাসে সভা, আলোচনা, এগুলো কমেছে। প্রস্তাবও কম আসছে। আশা করি নির্বাচনের পরপরই বিদেশী বিনিয়োগের ভালো প্রবাহ দেখতে পাব। বিদেশী দল যারা আসছে তাদের সঙ্গে আলোচনা ও পর্যবেক্ষণে এ মনোভাব বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে দুই থেকে তিনটি দল আসার কথা, কিন্তু তারা আসেনি, পিছিয়ে দিয়েছে। আসলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। গত দুই বছরে যতগুলো দল এসেছে সবাই দুটি বিষয় দেখতে চায়। একটি হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দ্বিতীয়ত, বিদেশীরা বিনিয়োগের মাধ্যমে যে মুনাফা করবে সেটা সহজে নিয়ে যেতে পারবে কিনা।’
বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই এফডিআই প্রবাহ এবং সেখানে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক নিম্নমুখী হচ্ছে। তারা বলছেন, বৈশ্বিকভাবেই দেখা যাচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ নিম্নমুখী। যেহেতু এখন বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এফডিআই আসার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, সেখানেই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে রক্ষণশীল হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়ায় আঙ্কটাডের রিপোর্ট অনুসারে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী এফডিআই ১২ শতাংশ কমেছে। ওইসিডির রিপোর্ট ইঙ্গিত করে যে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম ছিল। বাংলাদেশে সবসময় জিডিপির শতাংশ হিসাবে তুলনামূলকভাবে কম এফডিআই ছিল, তাই বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য সংকোচন এবং নির্বাচনের আগের এক বছরে কম এফডিআই পর্যবেক্ষণ করা আশ্চর্যজনক নয়। বিডার সঙ্গে অংশীদারত্বে এফআইসিসিআই নির্বাচনের পর চিহ্নিত অ্যাঙ্কর বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চায়।’
বনিক বার্তা