- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ জুন ২০২৩
নতুন পার্লামেন্ট ভবনে ‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র –
ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে একটি ‘অখণ্ড ভারত’-এর মানচিত্র রাখা হয়েছে, যেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা– সব দেশকেই দেখানো হয়েছে।
‘অখণ্ড ভারত’-এর ধারণাটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম। ওই ধারণায় বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে ইরান থেকে বর্তমানের মিয়ানমার, উত্তরে তিব্বত, নেপাল, ভূটান আর দক্ষিণে বর্তমানের শ্রীলঙ্কা– সবই ছিল অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠছে একটি দেশের সংসদ ভবনে প্রতিবেশী দেশগুলির এলাকাসহ কোনও মানচিত্র কেন রাখা হবে- তা নিয়ে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংসদ ভবনের এই মানচিত্র নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে একটা ভুল বার্তা দেবে।
কী এই ‘অখণ্ড ভারত’-এর ধারণা?
আরএসএস বলছে অখণ্ড ভারত হলো প্রাচীন সাংস্কৃতিক ভারতবর্ষ। যেসব এলাকায় ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল প্রাচীনকালে, তা নিয়েই ‘অখণ্ড ভারত’।
আরএসএসের নেতা জিষ্ণু বসু বলছেন, ‘গান্ধার থেকে ব্রহ্মদেশ, দক্ষিণে সিংহল- গোটা অঞ্চল জুড়েই তো একই সংস্কৃতি ছিল একটা সময়ে। এটাই তো ছিল ভারতের প্রাচীন রূপ। আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধ বলুন বা সিন্ধু সভ্যতার যে সব নিদর্শন বর্তমান পাকিস্তানে আছে, সেগুলো তো ভারতেরই এলাকা ছিল। আবার বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়েছিল, সেটাও তো ভারতবর্ষেরই অঙ্গ ছিল। ভারতের এই সাংস্কৃতিক ইতিহাস যাতে মানুষ ভুলে না যায়, সেজন্যই অখণ্ড ভারতের চিন্তা তুলে ধরা হয়।’
তিনি বলেন, ‘অখণ্ড ভারতের ভাবনা যে শুধু সঙ্ঘের, তা নয়। ঋষি অরবিন্দও পণ্ডিচেরি আশ্রমে যেখানে বসতেন, তার পিছনেও এই একই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র থাকত। অনেক মনীষীই অখণ্ড ভারতের কথা মেনে চলতেন।’
হিন্দুত্ববাদের গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছেন, ‘সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক, বা সঙ্ঘ প্রধান এম এস গোলওয়ালকর এই অখণ্ড ভারতের চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তার পরেও সংঘের অনেক তাত্ত্বিক নেতা অখণ্ড ভারত নিয়ে লিখেছেন। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী অখণ্ড ভারতের শুরু হয়েছিল বর্তমান ইরান থেকে। সেটাকে আগে পারস্য বলা হতো, কিন্তু আরএসএস সেটাকে মনে করে পরশুরামের জন্মস্থান, তাই তারা এটিকে পরশুদেশ বলে। আবার নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবটাই প্রাচীন ভারতের অংশ বলে তারা মনে করে।’
তিনি বলছিলেন, ‘শুধু যে সঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতারা এ নিয়ে লিখেছেন, তা নয়। সংঘের অধীন যে কয়েক হাজার স্কুল আছে বিদ্যা ভারতী নামে, এবং যে সকল বিদ্যালয় চালায় সঙ্ঘ, সেখানে একেবারে নিচু ক্লাস থেকে এই তত্ত্ব পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীদের এবং শিক্ষকদের এ বিষয়টা পড়া বাধ্যতামূলক। পরীক্ষার প্রশ্নও আসে।’
‘বিদ্যা ভারতী সংস্কৃতি শিক্ষা সংস্থান’এর চতুর্থ শ্রেণীর একটি বইতে ‘ভারতের বর্তমান ভৌগলিক সীমা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদের প্রশ্ন-উত্তর অংশে লেখা হয়েছে : ‘আমাদের দেশের বর্তমান সীমা-সংলগ্ন কোন কোন দেশ আমাদের দেশের অঙ্গ ছিল? উত্তর : পূর্বে ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), বাংলাদেশ। পশ্চিমে পাকিস্তান, আফগানিস্তান। উত্তরে তিব্বত, নেপাল ও ভূটান। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা।’
ওই একই পরিচ্ছেদে আরব সাগরের নাম বলা হয়েছে সিন্ধু সাগর আর বঙ্গোপসাগরের নাম বলা হয়েছে গঙ্গাসাগর।
সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র কেন?
সেই চিন্তাধারার প্রতিফলন দেশের সংসদ ভবনে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি বসু। তিনি বলেন, ‘এটা তো সরকারি সিদ্ধান্ত। তারা কেন এই মানচিত্র সংসদ ভবনে রেখেছে, কী চিন্তা করে রেখেছে, সেটা তো সরকার বলতে পারবে।’
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছেন সংসদীয় দপ্তরের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। তিনি ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র দিয়ে টুইট করেছেন : ‘সংকল্পটা স্পষ্ট – অখণ্ড ভারত।’
কর্নাটক বিজেপির টুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে ওই মানচিত্রের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘আমাদের গর্বিত মহান সভ্যতার জীবনীশক্তির প্রতীক।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’এর মানচিত্র রাখা, উদ্বোধনের হিন্দু রীতি মেনে যজ্ঞ করা বা বহু সংখ্যক হিন্দু সাধুসন্তদের উপস্থিতি, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ভারতকে একটা হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরারই প্রচেষ্টা।
লেখক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্তের কথায়, ‘একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদে কেন কোনও একটা বিশেষ ধর্মের রীতি মেনে যজ্ঞ হবে! কেন সেখানে একটা ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা হাজির হবেন? কেন সেখানে আরএসএসের চিন্তা অনুসারে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখা হবে? বার্তাটা খুব স্পষ্ট– ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরা।’
তিনি আরও বলছিলেন, ‘অখণ্ড ভারতের চিন্তাটাই তো বর্তমানে অবাস্তব। প্রাচীন কালে কোনও দেশের বিভাজন না থাকতে পারে, কিন্তু এখন তো প্রতিটা দেশের রাজনৈতিক সীমা নির্ধারিত হয়েছে, এখন অখণ্ড ভারতের রূপ কল্পনা করা কি বাস্তবসম্মত?’
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য যোগ করছিলেন, ‘অখণ্ড ভারতের তত্ত্বটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে নানা প্রচেষ্টা চলেছে। তারই একটা বৃহৎ প্রকাশ আমরা দেখছি ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পার্লামেন্ট ভবনে রেখে দেয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে দিয়ে সংঘের ওই মতাদর্শগত চিন্তাটাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হলো।’
‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভুল বার্তা যাবে’
সংসদ ভবনে যে মানচিত্রটি রাখা হয়েছে, সেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার- পুরো অঞ্চলটিকেই দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রী ওই মানচিত্রের যেসব ছবি টুইট করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে পাকিস্তান এবং নেপালের বিভিন্ন শহরের প্রাচীন নাম লেখা আছে, কিন্তু তিব্বত বা বাংলাদেশর অঞ্চলে কোনো প্রাচীন জনপদের নাম লেখা নেই।
তিব্বতের বিভিন্ন জনপদের প্রাচীন নাম লেখা হলে তা নিয়ে চীন আপত্তি তুলতে পারে ভেবেই সম্ভবত সেগুলোর নাম লেখা হয়নি। একই যুক্তিতে বাংলাদেশর অঞ্চলটিকে অখণ্ড ভারতের মধ্যে দেখানো হলেও সেখানকার কোনো প্রাচীন জনপদের নামও চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানচিত্র একটা ভুল বার্তা দেবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ইমন কল্যান লাহিড়ী।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাহিড়ী বলছিলেন, ‘এটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে ভারতের ভাবমূর্তি একেবারেই উজ্জ্বল করবে না। চারপাশে যতগুলো রাষ্ট্র আছে, প্রত্যেকের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে ভারত। এখন যদি অখণ্ড ভারতের মানচিত্র সংসদ ভবনে রাখা হয়, তার ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা কতটা?’
‘১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিকভাবে আমরা যে ভূখণ্ড পেয়েছি, ভারতবর্ষ সেই ভূখণ্ডের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। এর দর্শন, এর ধারণা অনেক গভীর। দেশ পরিচালিত হয় সংবিধান মেনে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনে। তাই এধরনের পদক্ষেপ প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবনতি হবে বলেই আমার মনে হয়,’ বলছিলেন লাহিড়ী।
সূত্র : বিবিসি