by Farhad Mazhar 19 July 2022
নড়াইলে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের উপস্থিতিতে জুতার মালা পরানো হয়েছিল। সেটা ছিল জঘন্য একটি ঘটনা। ধর্ম, ধর্মীয় অনুভূতি ইত্যাদি এইসকল ক্ষেত্রে স্রেফ উপলক্ষ্য হিশাবে কাজ করে। কোন একজন হিন্দু ফেইসবুকে মন্তব্য করে আর পুরা সম্প্রদায়কে স্রেফ হিন্দু হবার কারনে তার মূল্য দিতে হয়। এখন আবার সেই নড়াইলেই লোহাগড়ার দীঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কি তাদের অপরাধ? কে নাকি ফেইসবুকে ইসলামের নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছে। যে মন্তব্য করেছে সে যেহেতু হিন্দু তাই হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বলল।
এই ঘৃণ্য কাজের নিন্দার ভাষা আমার জানা নাই। তারপরও এই আশার আলোটুকু দেখি যে স্থানীয় জনগণ তার প্রতিরোধ করছেন। করবেন। সামাজিকতাই শক্তি। বাংলাদেশের জনগণ ঘোলা পানির মাছ শিকারিদের সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন। এই সচেতনতা আরও দৃঢ় করা দরকার। কিন্তু পাশাপাশি দরকার বড় প্রেক্ষিতে এই ধরণের ঘটনাকে বোঝা। কারণ, বিষয়টা গুরুতর। একে গোড়া থেকে বুঝতে হবে।
ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের পিটিয়ে মারে, তাদের বাড়ীঘর জ্বালানো হয় এবং সম্প্রতি দেখা গেছে বুলডোজার দিয়ে অবৈধ দখলদার দাবি করে মুসলমানদের বাড়ীঘর ভাঙা হচ্ছে। ভারতে গণহত্যার পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই উৎকন্ঠা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন প্রবল। তাহলে সর্বপ্রথম যে কাণ্ডজ্ঞান আমাদের থাকা দরকার সেটা হোল, ভারতের সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন করতে পারে এমন কোন প্রকার উসকানির ফাঁদে বাংলাদেশের পা না দেওয়া। কারন তার প্রতিক্রিয়া ভারতে মারাত্মক হতে পারে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক, নাগরিক কিম্বা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য নয়, ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী, জেলা প্রশাসক এবং সকল নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই ধরণের ঘটনা যেন ঘটতে না পারে তার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। যদি আমরা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারি, এবং এই ধরণের ঘটনা যদি বারবার ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি জেনেশুনেই এইসব ঘটনা ঘটবার জন্য প্রশ্রয় দিচ্ছে, উসকানি তৈরি করছে। তাই প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং আইনশৃংখলা বাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাহলে কি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকার চাইছে বাংলাদেশে ঘটনা ঘটিয়ে ভারতে মুসলমান নির্যাতন ও নিধন উস্কিয়ে দেওয়া?
যে কোন ছুতায় সংখ্যালঘু নাগরিকদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেবার ঘটনা নিন্দনীয়। একে নিঃশর্তে প্রতিরোধ করাতে যারা স্থানীয় ভাবে কাজ করছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই। ভারতের সংবেদনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি উস্কে দেবার কাজ কোন ভাবেই যেন বাংলাদেশ থেকে না হয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা জরুরি। আইনশৃংখলা বাহিনীর কি এ ব্যাপারে হুঁশ নাই? তারা কি বিস্ফোরনের সম্ভাবনা নিয়ে বারুদের ওপর বসা থাকা উপমহাদেশের পরিস্থিতি জানে না? বোঝে না? তাহলে একের পর এক এই ধরণের ঘটনা ঘটে কিভাবে?
লোহাগড়ায় সাধারণ নিরীহ নাগরিকদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটবার সময়টা খেয়াল করুন। গোতবায় রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার জনগণের গণভ্যূত্থান যখন সারা দুনিয়ার প্রধান আলোচ্য বিষয়, বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি সমস্যা, মুদ্রা স্ফীতি ও খাদ্য সমস্যা প্রবল, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলে সাধারন মানুষের ধারণা যখন প্রবল হচ্ছে তখনই ঘটনাটি ঘটল। এতে সন্দেহ দৃঢ় হয় যে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকেই বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়।
সমস্যাটা প্রথমত আইনশৃংখলার। দায় আইনশৃংখলা বাহিনীর, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বা প্রধান নির্বাহীর। নড়াইল লোহাগড়া থানার ওসি হারান চন্দ্র পাল এবং পুলিশ সুপার প্রবীর চন্দ্র রায়। ফ্যাসিস্ট সরকারের ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট অনুযায়ী অপরাধ করেছে আকাশ সাহা। কিন্তু আঙুল তোলা হচ্ছে উলটা দিকে। সেকুলারকুল মুসলমান্দের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে হা-হুতাশ করছে। এবারও যথারীতি ধর্ম বিশেষত ইসলামকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য রাষ্ট্রকে নয়, উলটা ধর্মকে একটি গোষ্ঠি পরিকল্পিত ভাবে দোষারোপ করে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিন্দুমাত্র আমলে নিয়ে এই দেশের সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে অপরাধের কাঠগড়ায় তারা দাঁড় করিয়ে দেয়। ক্রমাগত প্রচার করা হয় যে এই দেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নাই। অনেকে একে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র সমস্যা হিশাবে পর্যবসিত করতে চান, আবার অনেক মনে করেন ধর্মহীনতা কিম্বা ধর্মের অনুভূতির ক্ষয় এর জন্য দায়ী। উভয়েই ভুল। ধর্ম এখানে বিষয় না।
এভাবে পীড়িত বোধ করার দরকার নাই। দরকার মূল সমস্যার দিকে তাকানো।
কিন্তু কেন দরকার নাই? ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি হিন্দুত্ববাদী দিল্লীর তাঁবেদার। এই সেই হিন্দুত্ববাদ ইসলাম ও মুসলমানদের যারা উপমহাদেশে বহিরাগত মনে করে এবং নির্মূল করতে চায়। তাহলে এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পাহারাদার পুলিশের সামনে স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা ঝুললো কেন? বারবারই এরকম ঘটনা ঘটে কেন? কেন বারবার কেউ একজন ফেইসবুকে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’কে আঘাত করে, আর পরপরই সংখ্যালঘুদের জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। পুলিশ জানে, আমলারা জানে, কিন্তু যা ঘটবার ঘটে যায়।
কেন?