tbsnews.net 19 February 2023
যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের জনপ্রিয় ব্রান্ডের নামে নকল করে পোশাক রপ্তানির অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এনিয়ে একটি পর্যালোচনাও শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে করে শীর্ষ আমদানিকারকটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর কোটা আরোপ, নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাড়তি শুল্কারোপ করতে পারে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক পণ্যের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ ওঠায় ‘স্পেশাল ৩০১ রিভিউ অন আইপিআর প্রোটেকশন এন্ড এনফোর্সমেন্ট’ এর উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ– ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর), যা বৈশ্বিক মেধাসত্ত্ব রক্ষা ও কার্যকরের দিকটি তত্ত্বাবধান করে। এই পত্রিকার প্রাপ্ত একটি নথিতে এমনটাই উল্লেখ আছে।
এবিষয়ে নিজেদের প্রদত্ত প্রাইমারি সাবমিশনে (প্রাথমিক যুক্তিখণ্ডন পত্র) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, প্রমাণ ছাড়া এ ধরণের অভিযোগ তোলা যৌক্তিক নয়।
এদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরাও বলছেন, তারা কখনো এমন কাজ করেননি। তারপরও যদি অভিযোগগুলো সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি/ জরিমানার মুখে পড়তে হবে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও রপ্তানিকারকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রান্ডগুলোর প্রভাবশালী সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল এন্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) এবং প্যারিস-ভিত্তিক ইউনিয়ন ডেস ফেব্রিক্স (ইউনিফ্যাব)- যেটি নকল প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের পক্ষে– তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিয়েছে।
এর আগে নকলের অভিযোগে রিভিউ ৩০১ এর বিষয়টি গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন সময় ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আগেই বাংলাদেশকে সাবমিশন পাঠাতে বলেছে দেশটি।
এর প্রেক্ষিতে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে স্টেকহোল্ডার সভায় প্রাইমারি সাবমিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, প্রাইমারি সাবমিশনে বিস্তারিত সাবমিশন পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৫ দিন সময় চাওয়া হবে। এছাড়া, কাউন্টারফিট (নকল) প্রতিরোধে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার বর্ণনা থাকবে।
এই প্রথম কোনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) বিরুদ্ধে এ ধরণের পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এএএফএ আরো বলেছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন মেধাসম্পদ সুরক্ষাকে (আইপি) অগ্রাধিকার দেয়নি। এজন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি তারা বাংলাদেশকে একটি উচ্চ নজরদারি তালিকায় রাখতে বলেছে।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের স্টেকহোল্ডার সভায় উপস্থিত ছিলেন; তিনি বলেছেন, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক রপ্তানির কোটা নির্ধারণ বা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে পারে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ এসব অভিযোগ তদন্ত করবে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
হাতেম বলেন, ‘এ বিষয়ে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ কঠোর অবস্থানে থাকবে। আমরা কখনও কাউন্টারফিট করা কাউকে ছাড় দেইনি, ভবিষ্যতেও দেব না’।
অভিযোগসমূহ
ইউএসটিআরে দেওয়া তাদের সাবমিশনে এএএফএ বলেছে, “পোশাক সংগ্রহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ন্যায্য উৎস হওয়ার পরও, অব্যাহত হারে বাংলাদেশ থেকে নকল করা পণ্যের বৈশ্বিক বিস্তার এবং উৎপাদন বাড়ছে। এক সদস্য জানিয়েছে, ‘মেধাস্বত্ব রক্ষার প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার অনুপস্থিতি এবং উচ্চ পর্যায়ে চরম দুর্নীতির কারণে মেধাস্বত্ব আইন নিশ্চিত করাও অসম্ভব। এজন্য বাংলাদেশকে ইউএসটিআর- এর উচ্চ নজরদারি তালিকায় রাখার সুপারিশ করছে এএএফএ’।
এএএফএ আরো উল্লেখ করে যে, ২০২২ সালে তারা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ৫৬টি নকল পণ্যের চালান জব্দ করেছে, ২০২১ সালের চেয়ে যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত নকল পণ্য জব্দ করা হয়েছে এমন ১২টি দেশের তালিকা দিয়েছে তারা, এতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও সৌদি আরবের মতো দেশ।
তারা জানায়, ‘মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে পরিচালিত ১৭টি অভিযানে এক লাখ ৭৫ হাজার আইটেম জব্দ করা হয়, এর শতভাগ পণ্য ছিল বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত’।
এএএফএ সতর্ক করে বলেছে, ‘বাংলাদেশকে বৈশ্বিক নকল পণ্যের উৎস হিসেবে বিকাশের ছাড় দিলে এর এতোটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে, যা নিরসন করা কঠিন হবে’।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, লিঙ্কডইন, লাজডা, শপি-সহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে তারা বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত নকল পণ্যের ৫ হাজার লিস্টিং চিহ্নিত করেছে।
তাদের আরো অভিযোগ, ‘বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জব্দকৃত পণ্যগুলোর উৎস বাংলাদেশ হলেও, সেখানকার দুটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা– র্যাব এবং সিআইডি মেধাস্বত্ব রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয় না এবং তারা দুর্নীতিগ্রস্ত’।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কর্মকর্তারা জানান, আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় বলবে, এলডিসি হিসেবে মেধাসম্পদ অধিকারে বাংলাদেশের কিছু নমনীয়তা রয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ ট্রেডমার্ক অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করেছে, যেখানে নকল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাস্টমস আইনেও এটি অপরাধ।
তবে মন্ত্রণালয় স্বীকার করবে যে, আমদানি পণ্যের চালান যেভাবে পরীক্ষা করা হয়, রপ্তানির চালানগুলো ততোটা কঠোরভাবে চেক করা হয় না। ফলে বাংলাদেশ থেকে কিছু নকল হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে নকল পোশাক রপ্তানি হয়, এগুলো বন্ধ করা সেসব দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে যুক্তি দেবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরো জানান, প্রাইমারি সাবমিশনে আরো উল্লেখ করা হবে যে, বাংলাদেশের ডিজিটালসহ অন্যান্য আইনে নকল পণ্য সাইটে প্রদর্শন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে যারা নকল পণ্য আমদানি ও বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সংশ্লিষ্ট দেশের দায়িত্ব।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে (মেধা সম্পদ সুরক্ষা) আইপিআর পুরোপুরি কার্যকর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে এবং তা পূরণে বিভিন্ন দেশের সহায়তা নেওয়া হবে।
সমস্যাসঙ্কুল যাত্রা
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ, শুল্ক বৃদ্ধি বা অন্যান্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
তিনি বলে, বিশ্বব্যাপী মেধাসম্পদ রক্ষা নিয়ে এখন এখন অনেক ঝামেলা হচ্ছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন টেকনোলজি ওয়ার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের মতো ভালনারেবল দেশগুলোতে। আইপিআর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই এএএফএ এবং ইউনিফ্যাব- এর অভিযোগগুলো বাংলাদেশকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে’।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ডব্লিউটিও’র অ্যাপিলেট ডিভিশনে কোন বিচারক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে এবং তার বিরুদ্ধে ডব্লিউটি’র বিরোধ মীমাংসা আদালতে গেলে, সেখান থেকে কোনো সুরাহা পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ-র বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান শামস মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, “বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এ ধরণের অনিয়ম করার সুযোগ নেই। কেননা রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের যেসব নথিপত্র জমা দিতে হয়, তাদের পক্ষে কাউন্টারফিট হিসেবে পণ্য রপ্তানির সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বিজিএমইএ অত্যন্ত কঠোর। বরং বাংলাদেশে কিছু কাউন্টারফিট পণ্য বিদেশ থেকে আসছে।”
তবে তিনি মনে করেন, বিজিএমইএ সদস্য-বহির্ভূত কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ ধরণের অনিয়ম করা সম্ভব হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারখানা উদ্যোক্তা টিবিএসকে বলেন, “কখনো কখনো কিছু স্টক লটের পণ্য থেকে যায়, যা খোলাবাজারে বিক্রি হয়। এসব পণ্য বিদেশিদের কেউ কেউ কিনে নিয়ে নিজ দেশে বিক্রি করে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু পণ্য যেতে পারে’। এক্ষেত্রে কাস্টমস বিভাগের দায় রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া গত বছর বাংলাদেশ থেকে নকল পণ্য বেশি যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২০ সালে কোভিডের সময় অনেক অর্ডার বাতিল হওয়ায় ওই সময় বেশি পণ্য স্টক লট হয়েছিল, যা একটি কারণ হতে পারে।