- বদরুল মিল্লাত ইবনে হান্নান
- ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:৫১
অন্যান্য দিনের মতো ইউক্রেনের বাসিন্দারা সবাই গভীর ঘুমে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সূর্যোদয়ের আগেই রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে ঘিরে ফেলে। দেশের দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তরে শুরু করে হামলা। যদিও রাশিয়া তার আক্রমণকে যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং বলে যে, তারা ইউক্রেনে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালাচ্ছে।
প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষ এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি মানুষ বিস্মিত হয়েছিল ঠিক কী কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জোট এই আক্রমণের বিরোধিতা করছে। এই শান্তিপ্রিয় মানুষের বিস্ময়ের পেছনে কারণটা ভিন্ন। ধরে নেয়া হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জোট নৈতিকভাবে নিজেদের সংশোধন করেছে। তারা নিজেদেরকে শান্তিকামী মানুষের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করছে যদিও গোটা বিশ্ব ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়াতে গণতন্ত্রের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা প্রত্যক্ষ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় আক্রমণের মাধ্যমে অনেক দেশকে দারুণভাবে শিক্ষা দিয়েছে যার ফলে, অনেক দেশ যেমন- উত্তর কোরিয়া, ইরান পারমাণবিক বোমা ও প্রযুক্তিতে পরাশক্তি হতে চায় যদিও ইরান এবং তুর্কি ড্রোন প্রযুক্তিতে নিজেদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
আরেক কঠিন যন্ত্রণা মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত ইসরাইল। আরব ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তহীন সঙ্ঘাত অব্যাহত থাকবে। এই যুদ্ধ কবে থামবে, কেউ জানে না।
বিশ্ব থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো মনে করেছিল, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ অল্প সময়ের জন্য হবে। কিন্তু আমরা এর বিপরীত লক্ষ করেছি। এরই মধ্যে, মস্কো ইউক্রেনের ওপর হামলা আগের চেয়ে বাড়িয়েছে। Kh-47M2 Kinzhal নামে একটি রাশিয়ান পারমাণবিক সক্ষম হাইপারসনিক এয়ার-লঞ্চ করা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্প্রতি এই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।
কিনজাল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ান প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং ১ মার্চ ২০১৮-এ রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন কর্তৃক উন্মোচিত ছয়টি নতুন রাশিয়ান কৌশলগত অস্ত্রের মধ্যে Kh-47M2 Kinzhal ছিল একটি।
যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষ কেন সহ্য করবে?
প্রতিটি যুদ্ধ মানবতার জন্য অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নিয়ে আনে আমরা যদিও লক্ষ্য করছি যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামানোর কোনো উপায় নেই। এই যুদ্ধের দু’টি পক্ষ রয়েছে। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র এবং অন্যটি রাশিয়া।
আমরা যুদ্ধ সম্পর্কে একটি সমীকরণ আঁকতে পারি। যুদ্ধ = মানবতা/নিষ্ঠুরতা ((war=humanity/cruelty)। যুদ্ধ মানে, যত বেশি নিষ্ঠুরতা, তত বেশি মানবতার ধ্বংস। যুদ্ধ শুধু মানবতার জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে না; এটি প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অনেক বিপর্যয় নিয়ে আসে।
সিএনএনের তথ্যানুসারে, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের এক বছরের বার্ষিকীতে চীন ইউক্রেন সঙ্ঘাতের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আহ্বান করেছে, যেহেতু মস্কোর সাথে ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে আসছে বেইজিং।
সদ্য প্রকাশিত পজিশন পেপারে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। গত বছর পশ্চিমা নেতাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন চীনা নেতা শি জিনপিং এবং রাশিয়ার ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে জোর দিয়েছেন।
কিন্তু পশ্চিমারা যুদ্ধ বন্ধের এ ধরনের প্রস্তাব অস্বীকার করে। কেন আমরা রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে প্রশান্তিদায়ক কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না?
আমরা যুদ্ধের আরেকটি সমীকরণ আঁকতে পারি। আর তা হলো, রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের অহংবোধ (egoism)। অহঙ্কার=১/ক্রোধ (Egoism=1/anger)। এখানে, যত বেশি অহঙ্কার তত বেশি রাগ, তত বেশি যুদ্ধ এবং ১ (এক) মানে বিশ্ব শান্তি।
এ ধরনের অশান্তি অস্থিতিশীলতার পেছনে অহংবোধের অনেক কারণ রয়েছে। এই যুদ্ধের দু’টি পক্ষের রয়েছে বিশাল বিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ। অহংবোধের কারণে, যুদ্ধক্ষেত্র হলো, বিশ্বের কাছে নিজের শক্তি দেখানোর উপযুক্ত জায়গা।
অবশ্যই, যুদ্ধ এবং ব্যবসার মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। যুদ্ধের শক্তিশালী দল অন্যান্য দেশের কাছে অস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জাম বিক্রি করতে পারে। অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
বিশ্ববাসী দু’টি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ২৮ জুলাই, ১৯১৪ এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বুলগেরিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের মতো কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগদানকারী দেশগুলো অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং জার্মানিকে সমর্থন করেছিল। মিত্ররা ছিল রাশিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং গ্রেট ব্রিটেন, কিন্তু পরে জাপান, রোমানিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে যোগ দেয়।
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর অক্ষ শক্তি ছিল-জার্মানি, ইতালি, জাপান এবং মিত্র শক্তি ছিল-ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন।
যা হোক, সঙ্ঘাত এবং যুদ্ধ কারোই উপকার করে না। সব পক্ষকে অবশ্যই যৌক্তিক থাকতে হবে এবং সংযম অনুশীলন করতে হবে, আগুন জ্বালানো এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি করা এড়িয়ে চলতে হবে এবং সঙ্কটের আরো অবনতি হতে বা এমনকি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
দ্য ইকোনমিক হিটম্যান।
উইকিপিডিয়া অনুসারে, কনফেশনস অফ অ্যান ইকোনমিক হিট ম্যান হল জন পারকিন্সের লেখা একটি আধা-আত্মজীবনী, যা ২০০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
পারকিনস বর্ণনা করেছেন, তিনি করপোরাটোক্রেসি (একটি সিস্টেম বা সমাজ যেখানে করপোরেশনগুলো (গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো) অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বিচারিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ থাকে) এবং এটি একটি লোভনীয় সিস্টেম যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বিশ্ব সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে, যেখানে পারকিন্স গোয়েন্দাগিরির প্রভাব বিস্তারের জন্য ‘ইকোনমিক হিট ম্যান’ হিসেবে ভ‚মিকা নিয়েছিলেন। এই ক্ষমতায়, পারকিনস গ্রাহাম গ্রিন এবং ওমর টোরিজোসসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে তার বৈঠকের কথা বর্ণনা করেছেন। পারকিন্স একজন ইকোনমিক হিট ম্যান ব্যক্তির ভূমিকা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন :
ইকোনমিক হিট ম্যান (EHMs) হলো, উচ্চ বেতনের পেশাদার ব্যক্তি যারা বিশ্বব্যাপী অন্য দেশের সাথে ট্রিলিয়ন ডলারের গোপন ষড়যন্ত্র করে থাকে। তারা বিশ্বব্যাংক, ইউ এস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এবং অন্যান্য বিদেশী ‘সাহায্য’ সংস্থার কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ করপোরেশনের কোষাগারে এবং বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি ধনী কম্পানির পকেটে অর্থ প্রদান করে। তাদের হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে, প্রতারণামূলক আর্থিক প্রতিবেদন (Fraud Financial Statement), কারচুপির নির্বাচন, অর্থ প্রদান, চাঁদাবাজি, যৌনতা এবং হত্যা। তারা সাম্রাজ্যের বিস্তারের মতো পুরনো একটি খেলা খেলে, তবে বিশ্বায়নের এই সময়ে সাম্রাজ্যের বিস্তারের এই খেলা নতুনভাবে এবং ভয়ঙ্কর মাত্রায় রূপ ধারণ করেছে।
যুদ্ধ এবং মার্কিন অর্থনীতির মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি হলো, পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া যদিও ট্রাম্প সাধারণত তার বক্তৃতায় স্বীকার করেন যে, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে চান, পুরো বিশ্বের প্রেসিডেন্ট নয়। শীর্ষস্থান ধরে রাখার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই নিজদের প্রযুক্তিতে, বৈদেশিক নীতিতে এবং একটি বিশ্ব রিজার্ভ মুদ্রাকে (World Reserve Currency) তৈরি করে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে।
চলুন, ডলারের ইতিহাসের অংশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ডলার বর্তমান বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত মার্কিন ডলার রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হতো না।
যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনীতিকে শক্তভাবে গুছিয়ে রাখতে নিযুক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ ব্যবসায় এবং অর্থনীতি মিত্র শক্তির দেশগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কয়েক বছরের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯১৩ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি এবং রফতানির প্রবৃদ্ধিতে তারা তাদের অর্থনীতিকে শক্তভাবে গুছিয়ে রাখতে খুব ব্যস্ত ছিল। ১৯১৩ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি ছিল ৪.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ১৯১৭ সালে ৬.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে যেটা চার বছর পর বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৭ সালে শেষ হয়েছিল অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। ওই সময়ে উসমানীয়রা তাদের রাজতন্ত্র হারায়, সৌদি আরবে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং বিশ্ব অর্থনীতি খুবই অস্থির হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশির ভাগ দেশ, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের স্বর্ণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষণ করেছিল। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৪২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের ২০ হাজার টন সোনার মজুদ ছিল। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এটি আমেরিকার জন্য আশীর্বাদ ছিল। কারণ এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা বিশাল ব্যবসা করেছিল। আমেরিকার জন্য শুধু একটি ব্যতিক্রম ঘটেছিল। এটি ছিল, জাপানকর্তৃক পার্ল হার্বার আক্রমণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় সেপ্টেম্বর ০২, ১৯৪৫। এরই মধ্যে, ১৯৪৪ সালের ০১ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে ব্রেটন উডস চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বের ৪৪টি দেশ থেকে প্রায় ৭৩০ জন প্রতিনিধি চুক্তিতে উপস্থিত ছিলেন। সব প্রতিনিধি স্বর্ণের ভিত্তিতে মার্কিন ডলারকে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে বজায় রাখার জন্য সম্মতি দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রিচার্ড নিক্সনের স্বর্ণের মান থেকে ডলার অপসারণের ঘোষণার পর থেকে ডলার আরো বেশি শক্তিশালী হতে শুরু করেছিল। তার কৌশল ছিল যে, পেট্রোডলার নামে পরিচিত সোনার পরিবর্তে ডলারে তেলের লেনদেন হবে। আজকের যে ডলারকে আমরা এখন বিশ্বের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে দেখছি তার পেছনে রয়েছে সৌদি আরবের তেলের অনেক বেশি অবদান।
১৯৪৪ সাল থেকে কেন মার্কিন ডলার ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছিল? এর সম্ভাব্য কারণগুলো রয়েছে-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বহুমুখী অর্থনীতি। তাদের রয়েছে শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর এবং মেশিনারি সেক্টর। সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত। ওদের আছে শক্তিশালী মিডিয়া এবং রয়েছে সবচে উন্নত শিক্ষা খাত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব সেক্টর নীতি এবং কৌশলগুলোর জন্য আরো অনুমানযোগ্য (forecastable)। মজার বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কালি, কাগজ মেশিন দিয়ে ডলার প্রিন্ট করতে পারে সেখানে অন্যান্য দেশ ডলার আয় করে অর্জন করতে হয়। সুতরাং, আমেরিকা উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে অনুদান হিসেবে প্রচুর ডলার দিয়ে থাকে।
যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মার্কিন অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনটি ব্যাংক ধসে পড়েছে- সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক, সিগনেচার ব্যাংক এবং সিলভারগেট ব্যাংক। ব্যাংকের এমন পতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘটনা, ফেডারেল রিজার্ভ মার্চ ২০২২ থেকে সুদের হার আক্রমণাত্মকভাবে বাড়িয়ে চলেছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য, ফেড এখন পর্যন্ত ৪.৫ শতাংশ হার বাড়িয়েছে। এর জন্য ট্রেজারি বিলের নিম্নমুখী অবস্থান এবং বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের নিম্নমুখী অবস্থান ও সমানভাবে দায়ী। তবে ব্যাংক ধসের ব্যাখ্যা আরো বিশদ।
ফেড এর সুদের হার বাড়ানো অনেকটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বেশি হলে, আমেরিকায় অর্থ স্থানান্তর করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ থাকে যা কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছাড়াই বেশি রিটার্ন লাভের আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা বা তার সমর্থিত যেকোনো তৃতীয় দেশকর্তৃক মানি লন্ডারিং, হুন্ডির মাধ্যমে অন্য কোনো দেশে অবস্থিত আমেরিকান ব্যাংক বা ব্যাংকগুলোতে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেয়া।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক হিটম্যান হিসেবে প্রতিক্রিয়া কাজ করে। ফলে অনেক দেশই পেমেন্টের ভারসাম্য নিষ্পত্তি করতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেউলিয়া হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তান দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। অনেক দেশই টেনশনে আছে এবং ডলারের বিকল্প ভাবছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এর আগে অনেক দেশ ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
মেসেজিং নেটওয়ার্ক SWIFT USA এবং EU দ্বারা অর্থের অস্ত্রায়নের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এরই অংশ হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে হাজারো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ট্রেজারি অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (OFAC) ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল থেকে বিশেষভাবে মনোনীত নাগরিক এবং অবরুদ্ধ ব্যক্তিদের (SDN) সাথে আড়াই হাজারটি রাশিয়া-সম্পর্কিত লক্ষ্যযুক্ত (targeted) করেছে, যার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৪০০ ব্যক্তি এবং সংস্থা, ১১৫টি জাহাজ ও ১৯টি বিমান রয়েছে।
ওয়্যার এবং রকের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার রিজার্ভ মুদ্রা জব্দ করেছে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের (রাশিয়ান জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশের সমতুল্য), বিভিন্ন ব্যক্তি এবং রাশিয়ান ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করে এবং SWIFT অর্থপ্রদানে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করে। এই ধরনের স্যাংশন পদ্ধতি, আমরা অতীতে আফগানিস্তান, ইরান ও ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলোতে প্রয়োগ করতে দেখেছি, তবে এই নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজটি অভূতপূর্ব, শুধু এর পরিধি এবং মাত্রার কারণেই নয়; বরং এটি একটি বড় বিশ্ব শক্তিকে লক্ষ করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, রাশিয়া নন-ডলার পেমেন্ট-সিম লেনদেনকে উৎসাহ দিচ্ছে এবং নন-ডলার রিজার্ভ নিষ্কাশন করতে চাচ্ছে। বিকল্প হিসেবে ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক স্যাংশনকৃত অন্যান্য দেশ রাশিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নন-ডলার পেমেন্ট সিস্টেমে যোগদান করেছে। নন-ডলার পেমেন্ট সিস্টেমের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদেশ হলো- ভারত এবং চায়না। ভারত এবং চায়না রাশিয়ার সবচে বড় তেল আমদানিকারক।
ইতোমধ্যে, তেল রফতানিকারক দেশ, সউদি আরব ও আমিরাত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি শুরু করেছে যা তেল বাণিজ্যে অন্যান্য নজির স্থাপন করেছে।
ডলারের ভ‚মিকা গত দুই দশক ধরে হ্রাস পাচ্ছে, রিজার্ভ মুদ্রার অংশ সেই সময়ের মধ্যে ৭০ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অফিসিয়াল ফরেন রিজার্ভ ডেটার কারেন্সি কম্পোজিশনের একটি বিশদ বিশ্লেষণ দেখায়, ডলারের পতনের এক চতুর্থাংশ চীনা রেনমিনবি। এখন ২০২১ সালের শেষে মোট ফরেন রিজার্ভে প্রায় ১০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে রেনমিনবি।
এরই মধ্যে সৌদি আরব রেনমিনবিতে ( চায়না মুদ্রা ) তেল বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রিচার্ড নিক্সনের স্বর্ণের মান থেকে ডলার অপসারণের ঘোষণার পর থেকে মার্কিন ডলার সৌদি আরব সমর্থিত তেলের সাহায্যে বেড়ে ওঠে যা পেট্রো-ডলার নামে পরিচিত। এখন এটি পেট্রো-ইউয়ানের মতো হবে। কারণ চীন বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। এ ছাড়াও, চীন বাণিজ্যের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেছে এবং চীন এখন অনেক দেশকে রেনমিনবি দিয়ে পণ্য কেনার জন্য চাপ দিচ্ছে।
এখন রেনমিনবি দ্বারা ডলারের প্রতিস্থাপন হওয়া সময়ের ব্যাপার এবং এটি হবে পরবর্তী অর্থনৈতিক হিটম্যান।
লেখক : এমপিএ, অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সার্টিফাইড ফাইন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট (সিএফসি, আইএফসি, কানাডা), এসিসিএ (ফাইনাল লেভেল)। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।
ইমেলে[email protected]