- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ০৮ আগস্ট ২০২৩
দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ও স্মার্ট বাংলাদেশ। –
ক্ষমতাসী দল আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া এখন বড় অ্যাজেন্ডা। আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা জানুয়ারি ২০২৪-এর প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা ধরে রাখা সরকারের অগ্রাধিকার।
গত ৬ আগস্ট গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দলের বিশেষ বর্ধিতসভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো নির্বাচনে আসুক বা না আসুন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা সরকারের কাজ। দলের প্রায় পাঁচ হাজার তৃণমূল নেতা ও কেন্দ্রীয় নেতা সভায় অংশ নেন। তাদের মধ্য থেকে ৪৩ তৃণমূল নেতা মতামত তুলে ধরেন। প্রায় পাঁচ বছর পর এ বর্ধিতসভা হয়। সভাপতির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদেরই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষে কাজ করতে হবে। দলকে ক্ষমতায় রাখতে পারলেই আবার আপনারা গণভবনে আসতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সূত্র সংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশেষ বর্ধিতসভায় নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। জরুরিভাবে বিভিন্ন কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। সভায় জানানো হয়, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান স্লোগান হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে আওয়ামী লীগ অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার হিসেবে ‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতু’ নির্মাণ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বর্ধিতসভা সূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ নেতা মনে করেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারলে দলের জন্য সুবিধা ও ঝুঁকি কম।
বিশেষ বর্ধিতসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের সাড়ে ১৪ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে বেশি বেশি তুলে ধরার ওপর জোর দেন। প্রয়োজনে বুকলেট, ভিডিও-অডিও, গান-কবিতা এগুলো ছড়িয়ে দিতে বলেন। দেশের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় স্থাপনা ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণের বড় সাফল্য ফলাও করে প্রচার করার তাগিদ দেন। পাশাপাশি মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল সম্পর্কেও প্রচার চালাতে বলেন।
পদ্মা সেতু সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতির বাঁক বদল করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোজনও হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এ সেতু এখন অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি দারিদ্র্যপীড়িত জেলার উন্নয়নে গতি সঞ্চার হচ্ছে। পর্যটন, কৃষি, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসারে অর্থনীতিতে অনন্য মাত্রা যোগ করছে। ইতোমধ্যে সেতুটির সুফল মিলতে শুরু করেছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ফলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমে আসছে। এ সেতুর ফলে জিডিপিতে অতিরিক্ত বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারণ হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চলাচল বাড়ছে। পদ্মা সেতু শুধু পরিবহন চলাচলের করিডোর হিসেবে কাজ করছে না, অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে শিল্পায়নকেও এগিয়ে নেবে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করতে পারলে এ উন্নয়ন ধারা আরো গতি পাবে। তা ছাড়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার কিছু কাজও করেছে।
এবার দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর অঙ্গীকার
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এবার তুলে ধরা হবে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা। পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে ‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতু’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব।
মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর সরকার পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি অনুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইআরডির মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ মনে করে, এ মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে এ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি উদ্যোগে বিল্ট অপারেট ট্রান্সফার (বিওটি) বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা ডিজাইন বিল্ট বিডার্স ফাইন্যান্স বা পিপিপি উইথ এ্যামুনিটি পেমেন্ট সিস্টেমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সহজে সম্ভব। এতে সরকারের নিজস্ব কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। এ ক্ষেত্রে বিডার্স সেতু নির্মাণে যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করবে। একই সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এ সেতু থেকে প্রাপ্ত আয়ে তাদের ব্যয় উঠিয়ে নেবে। তাই নির্বাচনী ইশতেহারে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর অঙ্গীকার করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে জাইকা পরিচালিত এক সমীক্ষায় পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাথমিক পর্যায়ে চারটি স্থান নির্ধারণ করা হয়। এগুলো হলো- পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, দোহার-চরভদ্রাসন, মাওয়া-জাজিরা ও চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাওয়া-জাজিরা ও পাটুরিয়া- গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারিত হয়। সেই সুপারিশ মোতাবেক মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে প্রথম পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল। সেটির বাস্তবায়ন এখন ক্ষমতাসীন আওয়ায়মী লীগের স্বপ্ন।
জাইকার সমীক্ষার ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মাওয়া-জাজিরা পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করে। পাশাপাশি তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বিস্তারিত সমীক্ষার পর প্রকল্পের পিডিপিপি ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট পরিকল্পনামন্ত্রী অনুমোদন করেন। বিদেশী অর্থায়নে ইআরডিতে তা পাঠানো হয়। সেই সময় উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এ প্রকল্পে অর্থায়নের ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় সরকার পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে চিন্তা করে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার মনে করে, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর ও গোপালগঞ্জের সাথে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের দূরত্ব মাওয়া-পয়েন্টের তুলনায় অনেক কম হবে। তাই এ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া এ সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে।
২০১০ সালে উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থার ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সেতুর গুরুত্ব বিবেচনায় বেসরকারি উদ্যোগ-বিওটি বা পিপিপি পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ বেসরকারি অর্থায়নে ২০০৯-১৪ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রাইভেট ইনফ্রাস্টাকচার কমিটি কর্তৃক অনুসৃত বাংলাদেশ প্রাইভেট সেক্টর ইনফ্রাস্টাকচার গাইডলাইন অনুসৃত জটিলতা এড়াতে প্রধানমন্ত্রী নিজ ক্ষমতা বলে ২১ জানুয়ারি, ২০১০ সালে বেসরকারি উদ্যোগে বিওটি/পিপিপি পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিনিয়োগকারী নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিলেন।
কিন্তু মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় ‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতু’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি অগ্রসর করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অজুহাতে অর্থায়ন থেকে সরে গেলে তখনো উদ্যোগ নেয়া হলে বিওটি/পিপিপি পদ্ধতিতে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে হতো না। বিশ্বব্যাংক আগের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আর বাধা নয়।
সরকারের নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পয়েন্টে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পদ্মা সেতু এখনো বিওটি/পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা যায়। প্রয়োজনে ডিজাইন বিল্ট বিডার্স ফাইন্যান্স বা পিপিপি উইথ এ্যামুনিটি পেমেন্ট সিস্টেম অনুসরণ করেও করা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। বেসরকারি বিনিয়োগকারী সমুদয় অর্থ ব্যয় করবে। বর্তমান সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারে তা উল্লেখ করতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখা সম্ভব হবে বলে ক্ষমতাসীন মহল মনে করে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ বেসরকারি উদ্যোগে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নিতে পারে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে যে সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েছিলেন, সে পথ অনুসরণ করে একটি নতুন সারসংক্ষেপ প্রণয়ন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দিতে পারেন বলেও জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগে বিওটি/পিপিপি/ডিজাইন বিল্ট বিডার্স ফাইন্যান্স বা পিপিপি উইথ এ্যামুনিটি পেমেন্ট সিস্টেম পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিনিয়োগকারী নিয়োগে টেন্ডার আহ্বান প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করে এগিয়ে থাকতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।