দোষ স্বীকারে সংবিধান ও আইনের অবস্থান

Daily Nayadiganta

দোষ স্বীকারে সংবিধান ও আইনের অবস্থান – ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার দেয়া হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের পর এ যাবৎকালে তাতে ১৫টি সংশোধনী আনা হলেও এ অনুচ্ছেদটি এককভাবে কখনো সংশোধনীর সম্মুখীন হয়নি, যদিও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমে এ অনুচ্ছেদটির ক্রমিক নম্বর পরিবর্তিত হয়ে ৫৭ হয় এবং অতঃপর পুনঃ দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদটি আগেকার ৪৯ নম্বর ক্রমিকে ফিরে আসে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত উভয় পদ্ধতি দ্বারা শাসিত হলেও এবং উভয় পদ্ধতির শাসনকালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেও এ অনুচ্ছেদটিতে রাষ্ট্রপতিকে যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা অপরিবর্তিত থাকে।

দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা থাকাকালীন এর নির্বাহী কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত ছিল যদিও বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় এটি প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমা প্রদর্শনের যে অধিকার দেয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি এককভাবে এ ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে পারতেন কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত এ ক্ষমতাটি অনুচ্ছেদ নম্বর ৪৮-এর দফা (৩) এ উল্লিখিত শর্তের অধীন। অনুচ্ছেদ নম্বর ৪৮-এর দফা (৩) এ বিবৃত হয়েছে সংবিধানের ৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা (৩) অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। উল্লিখিত অনুচ্ছেদের দফা (৩)-এর মর্মানুযায়ী, রাষ্ট্রপতি তার একক সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও তিনি তার অপর সব কার্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে সম্পন্ন করতে পারেন না। প্রণিধানযোগ্য যে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতাটি স্বেচ্ছাধীন নয়। এর কারণ হলো, জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী বা অন্য কোনো সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যতীত অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের সুযোগ নেই। অনুরূপ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যদি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠতম বিচারককে অতিক্রান্ত করেন সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যাকে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয় তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে।

রাষ্ট্রপতিকে ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এ ক্ষমতাটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দু’ভাবে প্রয়োগ করা হয়। এর একটি হলো বিচারিক আদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কর্তৃক ক্ষমা প্রার্থনা এবং অপরটি দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামিকে রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে সরকারের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শন। উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতাটি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ব্যতিরেকে সম্পন্ন করতে পারেন না।
আমাদের মূল দণ্ডবিধি অনুযায়ী একজন অপরাধীকে অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে বিচার সমাপনান্তে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক পাঁচ ধরনের দণ্ড দেয়া যায়। যথা- মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্তির দণ্ড ও অর্থদণ্ড। অনুচ্ছেদ নম্বর ৪৯-এ রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দয়া হয়েছেÑ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ সাপেক্ষে ওই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো দণ্ড মার্জনা, বিলম্বন, বিরাম, মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করতে পারেন। উপরোক্ত যেকোনো দণ্ডের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হলে তিনি ক্ষমার মাধ্যমে ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত যেকোনো প্রতিকার দিতে পারেন। স্পষ্টত, ক্ষমা প্রদর্শন ও প্রাণভিক্ষা এক বিষয় নয়। ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদের কোথাও প্রাণভিক্ষা বিষয় উল্লিøখিত হয়নি। প্রাণ যিনি দিতে পারেন তিনি হলেন একমাত্র মহান রাব্বুল আল আমিন। যিনি প্রাণ দিতে পারেন তিনি ব্যতীত অপর কারো প্রাণভিক্ষা দেয়ার ক্ষমতা নেই। একজন মানুষের জন্মের মতো মৃত্যু কখন, কোথায়, কিভাবে হবে তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন জানেন এবং এটি আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত।

রাষ্ট্রপতি তার এ ক্ষমতাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে দণ্ডিতদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে একজন ব্যারিস্টার খেতাবধারী সাবেক আইনমন্ত্রীর অভিমত- ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ওই আইনে দণ্ডিতদের ক্ষেত্রে তার এ ক্ষমতাটি প্রয়োগ করতে পারবেন না। এ বিষয়ে আমাদের সংবিধান অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, অনুচ্ছেদটিতে রাষ্ট্রপতিকে মৃত্যুদণ্ডসহ অপর যেকোনো ধরনের দণ্ড মার্জনা, বিলম্বন, বিরাম, মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাসের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সে অনুচ্ছেদটিতে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্রপতি তার এ ক্ষমতাটি যেকোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীন অভিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের জন্য রিটের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রতিকার চাওয়ার অধিকার খর্ব করা হলেও তা ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে কোনোভাবেই খর্ব করে না। আর তাই এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৪৯-এর চেতনার আলোকে যথার্থ নয় বিবেচিত হয়। উল্লেখ্য, সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদে দফা (৩) ও ৪৭ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়Ñ যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ, ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা (১) ও (৩) এবং ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হবে না।

রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের যে অধিকার দেয়া হয়েছে মূলত এ অধিকারটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি উপলক্ষ মাত্র। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের সুপারিশ ব্যতিরেকে নিজ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ক্ষমাপ্রার্থীকে কোনো প্রতিকার প্রদান করতে পারেন না। আমাদের সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সরকারের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত থাকায় প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষাই সরকারের আকাক্সক্ষা। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ করা হয় প্রকারান্তরে সেটি সরকারেরই সুপারিশ।

সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতিকে যেরূপ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধিতে কতিপয় দণ্ডের ক্ষেত্রে সরকারকে অনুরূপ ক্ষমতা এবং মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে অনেকটা সমরূপ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৪০১, ৪০২ ও ৪০২ক প্রাসঙ্গিক। আলোচ্য নিবন্ধ সংশ্লেষে ধারা নম্বর ৪০১-এর উপধারা (১), (২) ও (৫) বিশেষভাবে সম্পৃক্ত।
ধারা নম্বর ৪০১-এর উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তিকে কোনো অপরাধের দায়ে দণ্ড দেয়া হয় সরকার যেকোনো সময় শর্তবিহীন অথবা দণ্ডিত ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত শর্তসাপেক্ষে, তার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত অথবা আরোপিত দণ্ড সম্পূর্ণ বা আংশিক মওকুফ করতে পারে।

ওই ধারার উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, সরকারের কাছে যখন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফের আবেদন করা হয়, সরকার প্রয়োজনে যে আদালতের বিচারক কর্তৃক দণ্ড প্রদান অথবা নিশ্চিত করা হয়েছে আবেদনটি মঞ্জুর অথবা নাকচ বিষয়ে যুক্তিসহ তার মতামত প্রদানের জন্য বলতে পারে এবং ওই মতামতের বর্ণনার সাথে বিচারিক নথির অনুলিপি অথবা ওই নথি যে অবস্থায় আছে তা অগ্রগামী করার জন্য বলতে পারে।
একই ধারার উপধারা (৫)-এ বলা হয়েছে, এ ধারার অন্তর্ভুক্ত কোনো কিছুই রাষ্ট্রপতির দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন, বিরাম ও মওকুফের অধিকারের প্রতি হস্তক্ষেপরূপে বিবেচিত হবে না।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০২ ধারায় বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ৫৪ ও ৫৫ ধারার হানি না-ঘটিয়ে সরকার দণ্ডিত ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে নিম্নলিখিত যেকোনো দণ্ডকে পরবর্তীতে বর্ণিত দণ্ডে হ্রাস করতে পারে, যেমন, মৃত্যুদণ্ডের স্থলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যেকোনো মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডের স্থলে যেকোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, কারাদণ্ডের স্থলে অর্থদণ্ড।

ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০২ক ধারায় বলা হয়েছে, ধারা নম্বর ৪০১ ৪০২-এর দ্বারা সরকারের ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রয়োগ করা যেতে পারে।

দণ্ডবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড দান করা যেতে পারে এরূপ প্রত্যেক ক্ষেত্রে সরকার অপরাধীর সম্মতি ব্যতিরেকে এ বিধির অধীন প্রদত্ত অপর কোনো দণ্ড হ্রাস করতে পারবে।
একই বিধির ধারা নম্বর ৫৫ অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করা যেতে পারে এরূপ প্রত্যেক ক্ষেত্রে সরকার অপরাধীর সম্মতি ব্যতিরেকে ওই দণ্ড যেকোনো প্রকারের অনূর্ধ্ব ২০ বছর মেয়াদের দণ্ডে হ্রাস করতে পারবে।

ফৌজদারি কার্যবিধির বর্ণিত দু’টি (৪০১ ও ৪০২) ধারা এবং দণ্ডবিধির বর্ণিত দু’টি (৫৪ ও ৫৫) ধারা থেকে যে ধারণাটি পাওয়া যায় তা হলো, এ দু’টি আইনের বিধান অনুযায়ী সরকার যেকোনো দণ্ড সম্পূর্ণ বা আংশিক মওকুফ অথবা হ্রাস করাসহ এর কার্যকারিতা স্থগিত করতে পারে।

আমাদের প্রচলিত দণ্ড আইনে যে পাঁচটি দণ্ডের বিষয় উল্লেখ রয়েছে এর মধ্যে সর্বোচ্চ হলো মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ সরকার কর্তৃক মওকুফ, হ্রাস বা স্থগিত করার বিধান থাকলেও তা ফৌজদারি কার্যবিধির অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় নয়। তা ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধিতে সরকারকে বিভিন্ন দণ্ড মওকুফ, হ্রাস বা স্থগিত বিষয়ে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা কোনোভাবেই সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন, বিরাম ও মওকুফ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির যে অধিকার রয়েছে এর প্রতি কোনোরূপ হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত নয়।

যেকোনো দণ্ডের ক্ষমা প্রদান বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান যে অধিকার দিয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ মওকুফ হ্রাস বা স্থগিত বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে রাষ্ট্রপতিকে যে অধিকার দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অত্যাবশ্যক। সুতরাং সংবিধানের ন্যায় ফৌজদারি কার্যবিধির অধীন মৃত্যুদণ্ডের অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কোনো প্রতিকার প্রদান করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের সুপারিশ ব্যতিরেকে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থনে নির্বাচিত হলেও তিনি দেশের সংবিধান ও সব নাগরিকের অভিভাবক। তা ছাড়া তিনি জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। রাষ্ট্রের ১ নম্বর ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। রাষ্ট্রপতির প্রতি দেশের সব নাগরিকের আস্থা ও বিশ্বাস যাতে অক্ষুণœœ থাকে সে বিষয়ে সবার বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের সচেষ্ট থাকা উচিত। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় যেহেতু যেকোনো দণ্ডের ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার প্রয়োগ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর বা সরকারের সুপারিশ অত্যাবশ্যক, সেহেতু ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্পৃক্ত না করে ফৌজদারি কার্যবিধির অধীন সরকারকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা প্রয়োগের মাধ্যমে যদি সম্পন্ন করা হয় তাতে রাষ্ট্রপতির প্রতি দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্ষুণœ হওয়ার কোনো ধরনের অবকাশ সৃষ্টি হবে না।

অতীতে রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়কে ব্যবহার করে যেমন অপ্রত্যাশিতভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় জঘন্য অপরাধীদের দণ্ড মার্জনা করা হয়েছে অনুরূপ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক দণ্ডিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত প্রতিকার দেয়া হয়নি যদিও উভয়টির কোনোটিই কাম্য নয়। আর তাই যেকোনো ধরনের দণ্ডের মার্জনা, মওকুফ ও হ্রাস বা স্থগিত বিষয়ে সরকারের রাষ্ট্রপতির ন্যায় অনুরূপ ক্ষমতা থাকার কারণে তা সরকার কর্তৃক প্রয়োগ যথার্থ বিবেচিত হয়।

রাষ্ট্রপতি বা সরকার কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধির অধীন কোনো অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তা শর্তবিহীন অথবা দণ্ডিত ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত শর্তসাপেক্ষে এবং ক্ষেত্রবিশেষে যে বিচারিক আদালত কর্তৃক দণ্ড দেয়া হয়েছে ওই আদালতের মতামতসাপেক্ষে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীন যখন কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করা হয় তখন সেখানে কোনো ধরনের শর্ত বা আদালতের মতামতের আবশ্যকতা নেই।

দণ্ডপ্রাপ্ত একজন অপরাধী সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতির কাছে মৃত্যুদণ্ড অথবা অন্য যেকোনো ধরনের দণ্ড মার্জনা বা মওকুফের আবেদনের ক্ষেত্রে তার জন্য দোষ স্বীকার অত্যাবশ্যক কি না এ প্রশ্নে আইনজ্ঞ, আইনের শিক্ষক, আইনের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে। একটি মত হলো, একজন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী মৃত্যুদণ্ড বা যেকোনো দণ্ডের মার্জনা বা মওকুফ চাইলে তাকে অবশ্যই রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার ক্ষেত্রে দোষ স্বীকারপূর্বক আবেদন করতে হবে। অপর মতটি হলো, ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক আবেদন করতে হবে এবং দোষ স্বীকার অত্যাবশ্যক নয়। দ্বিতীয় মতামতটি যারা ধারণ করেন তারা উল্লেখ করেন, ইতঃপূর্বে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অপরাধীর আপিল উচ্চাদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অপরাধীকে দণ্ড মার্জনাপূর্বক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার নজির রয়েছে। তাদের অভিমত, এ ধরনের অপরাধী যদি ক্ষমা প্রার্থনার সময় দোষ স্বীকার করেন সে ক্ষেত্রে তাকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বা সরকারের কোনো পদে নিয়োগের সুযোগ নেই। এ ধরনের নিয়োগ যেহেতু অদ্যাবধি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি, তাই দ্বিতীয় মতটি যথার্থ প্রতীয়মান হয়। তা ছাড়া সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এমন কিছু ব্যক্ত হয়নি যাতে ধারণা করার অবকাশ সৃষ্টি হয় যে, যেকোনো দণ্ডের মার্জনা বা মওকুফের প্রার্থনার ক্ষেত্রে দোষ স্বীকার অত্যাবশ্যক।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

E-mail: [email protected]