দোষারোপের রাজনীতি

দোষারোপের রাজনীতি

Daily Nayadiganta

‘দোষ’ এমন একটি বিষয় যা কিছুতেই কেউ নিজ ঘাড়ে নিতে চায় না। চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও সে বলবে, আমি দোষী নই। হাতেনাতে চোর ধরার পরও সে আকুতি জানায়, এ কাজ তাকে দিয়ে হয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পঞ্চতন্ত্রে’ আছে, বয়সী ছাত্র সে কালে সিলিম হাতে তামাক খেতে গিয়ে ধরা পড়ে বলে ‘মাস্টার মশাই, কে যেন আমার হাতে এসব ধরিয়ে দিয়েছে’। গ্রামদেশে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে একটা কথা আছে। পাড়াময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সে তার চোর সন্তানের সাফাই গায়। সে (বিশুদ্ধ বরিশালি ভাষায়) বলে, ‘মোগো পোলাডারে আমনেরা কোনো দিন চুরি করতে দ্যখছেন, না হোনছেন… ও বাড়ির পোলা লেউদ্দা হারামি, মোর পোলাডারে তোতাইয়া বুতাইয়া লইয়া গ্যাছে।’ অর্থাৎ চোরের মা বলছে, তার ছেলে খুবই ভালো। পাশের বাড়ির ছেলেটি চুরির জন্য দায়ী; তার ছেলে নয় (যদিও চুরির মাল তার ঘরেই পাওয়া গেছে)।

অনেক দিন আগে থেকেই রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলে আসছেন, রাজনীতিতে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে পড়েছে। কেউ বলছে, পলিটিক্স নয় ‘পলিট্রিকস’ অর্থাৎ বহুমুখী কারসাজি। কেউবা বলছেন, ‘পলিটিক্স’ আজ ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ হয়ে গেছে। আমরাও বারবার এ কলামে দেখাবার চেষ্টা করেছি, কিভাবে আমাদের জাতীয় রাজনীতি তার মান-মর্যাদা ও মাধুর্য হারিয়ে ‘ভিলেজ পলিটিক্সে’ পরিণত হয়েছে। দোষের কারণে ব্যর্থতা স্খলনের আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে অজুহাত বা বাহানা। সেখানেও নিজের দোষ বা ব্যর্থতা ঢাকার জন্য আমরা নানা ধরনের অজুহাত, বাহানা বা বানোয়াট কারণ খুঁজি। আপনার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় কেন গোল্ডেন এ প্লাস পেল না, এর উত্তরে আপনি কি আপনার ছেলের ব্যর্থতার কথা বলবেন? সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে- এ কথা বলা যে, ছেলেটি অসুস্থ ছিল, স্কুলে ভালো পড়ালেখা হয়নি অথবা সাংসারিক ঝামেলা ছিল প্রভৃতি। আপনি কিছুতেই বলতে চাইবেন না যে, আপনার ছেলের মেধায় কমতি আছে। এভাবেই আমরা ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক ব্যর্থতার খতিয়ান খুঁজি।

বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু আমাদের জাতীয় চরিত্রের বাইরের কিছু নয়, সে জন্য আমরা নিজেদের রাজনীতিতে দোষারোপের প্রাধান্য দেখতে পাই। শাসক দল বরাবরই তাদের ব্যর্থতার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে। অন্য দিকে, বিরোধী দল তাদের ব্যর্থতার জন্য সব সময়ই সরকারকে দায়ী করে থাকে। বিশেষত, স্বাধীনতার পর থেকে এ প্রবণতা চলে আসছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রশাসনিক এবং আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতাকে তখনকার প্রধান বিরোধী দল জাসদের কাঁধে তুলে দিতে চাইত। সরকারের বক্তব্য ছিল জাসদসহ ‘স্বাধীনতাবিরোধী’রা অস্ত্র জমা দেয়নি।

তারা ‘গণবাহিনী’ সৃষ্টি করে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখছে; বোমাবাজি করছে; মিটিং-মিছিল করছে। কিন্তু সরকার প্রশাসনিকভাবে, সুশাসন নিশ্চিত না করে তারা মানুষের স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার কথিত উন্নতি বিধানের চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা’ করে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে তারা। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের জন্য নিজেদের চেহারা আয়নায় না দেখে দূরের রাষ্ট্রকে দায়ী করে থাকে। শাশ্বত জীবনবোধকে স্বীকৃতি না দিয়ে পরাজিত মানসিকতার পুনরাবৃত্তি খোঁজে।

অতীতের এসব প্রবণতা এখনো বিদ্যমান আছে। বিগত ৩০ আগস্ট ছিল ‘আন্তর্জাতিক গুম দিবস’। এ দিন ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়াদের পরিবারের তরফ থেকে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মন্তব্য করেন, সরকার গুম-খুনের দায় এড়াতে পারে না। তারা সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে তারা গুম ও খুনের তদন্ত করার দাবি জানান। আওয়ামী লীগের শাসনের গত এক যুগে গুম তথা অপহরণের একটি বিস্তারিত পরিসংখ্যান ওই সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বিএনপির মহাসচিব মন্তব্য করেন যে, গুম ও খুনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার একদিন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হবে। একই দিন ‘জাতীয় শোক দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অভিযোগ করেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দেশে সর্বপ্রথম গুম-খুনের রাজনীতি শুরু করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের দলের লোকদের হত্যা করা হয়েছিল, এমন নয়। সেনাবাহিনীর যারা জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সে রকম বহু অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। হাজার হাজার সৈনিককে দিনের পর দিন ফাঁসি দিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। শোনা যায়, জিয়াউর রহমান খেতে খেতে এ রকম মৃত্যুদণ্ডের ফাইলে সই করতেন। আট-দশজন করে জোড়ায় জোড়ায় তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাদের কান্নায় চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠত। আর এখন সেই বিএনপি গুম-খুনের কথা বলে।’ স্বাভাবিকভাবেই সরকার প্রধান গুম-খুন সম্পর্কে বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা এবং বিএনপির অভিযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন। এটি একটি নির্মম সত্য যে, এ দেশের কোনো সরকারই গুম-খুনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে পারে না। স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জাসদের অভিযোগ, সে সময়ে তাদের ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ঘরবাড়ি থেকে রক্ষীবাহিনীর লোকেরা ডেকে নিত একেক জনকে। পরে তাদের লাশ পাওয়া যেত এখানে সেখানে।

বামপন্থী নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয় এক রকম ঘোষিতভাবে। আর বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ অনেক দীর্ঘ। এবারের গুম দিবসে বুদ্ধিজীবীরা হিসাব কষে বলেছেন,গত এক দশকে দুই হাজার ৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কেবল গত বছরই নিহত হয়েছেন ৪৬৫ জন। মাদকবিরোধী যুদ্ধে গত এক-দেড় বছরে নিহত হয়েছেন ৪২৮ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো রকম বিচার এবং নিশ্চিত প্রমাণাদি ব্যতিরেকেই তাদের হত্যা করা হয়। প্যারিসের একটি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯- ২০১৮ সময়কালে এদেশে ৫০৭ জন গুম হয়েছে। এদের মধ্যে লাশ মিলেছে ৬৫ জনের। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গত এক যুগে অসংখ্য লোক প্রাণ হারিয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। পুলিশের নির্যাতনে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের হিসাব নেয়া হয়নি। ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়।

কিন্তু এ সময়ে আরো যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায় না। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের হামলায় সময়ে পুলিশসূত্রে মৃতের সংখ্যা ২২ বলা হয়। সরকারের অন্য সূত্রে, এটা ৩০-এর অধিক নয়। তবে হেফাজতের দাবি তাদের আড়াই থেকে তিন হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সে রাতে গুম ও নির্যাতনবিরোধী (সম্প্রতি সমাপ্ত) জেনেভা সম্মেলনে মানবাধিকারবিষয়ক দেশী-বিদেশী সংগঠনগুলো যে প্রামাণ্য প্রতিবেদন দিয়েছে, সংবাদপত্রে তা প্রকাশ হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিহত হয়েছে অনেক জঙ্গি। এখনো মাঝে মধ্যেই ‘জঙ্গি’ আস্তানায় অভিযানে অনেক মৃত্যুর খবর দেয়া হচ্ছে।

পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন শাসনকালে গুম-খুনের সংখ্যার চেয়ে এই সময়ের পরিসংখ্যানটি এককভাবে বেশি হবে। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন না তুলেই বলা যায়, ‘অপরে অধম হইয়াছে বলিয়া আমরা উত্তম হইব না কেন?’ মানুষ তো অতীতের চেয়ে আশা করে ভালো ভবিষ্যৎ। অপরের দোষ-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতির জন্য নির্মাণ করতে হবে স্বচ্ছ-সুন্দর বর্তমান। উপরিউক্ত কার্যব্যবস্থার বৈধতা বা অবৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে; আমরা শুধু সংখ্যাটির উল্লেখ করছি। আমরা বিশ^াস করি, শক্তি প্রয়োগের বৈধ অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে।

আলোচনা করছিলাম দোষারোপের রাজনীতি নিয়ে। সরকার সব সময় রিরোধী দলকে দুষছে; তেমনি বিরোধী দল কারণে অথবা অকারণে দায়ী করছে সরকারকে। উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বলা যায়। বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতা এটাই যে, তারা মিয়ানমারের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মিয়ানমার চীনের মধ্যস্থতা এবং আন্তর্জাতিক চাপে দেখাতে চেয়েছিল যে, তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তরিক। এ জন্য তারা তড়িঘড়ি করে দিনক্ষণ ঠিক করে দেয়। বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়- এমন বদনাম এড়ানোর জন্য আমাদের সরকারও প্রাসঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা ঘোষণা করে। বিএনপি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। সরকার এর মধ্যেও প্রত্যাবাসনবিরোধী ষড়যন্ত্রের আঁচ পায়। উভয় পক্ষের উচিত ছিল মিয়ানমারের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়ার।

সেখানে তারা পরস্পরকে দোষারোপ করে প্রকারান্তরে মিয়ানমারের উপকার করেছে। শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই দোষারোপের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কটি শুরু হয় শিশু হত্যা তথা গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার অভিযোগ থেকে। হাস্যকরভাবে সরকারের দায়িত্বশীল অংশ এতেও বিএনপির ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেছে। আবার যখন এডিস মশার উপদ্রব থেকে ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয় মহামারী আকারে, তখনো বিস্ময়করভাবে ‘ব্লেমগেম’ লক্ষ করা গেছে। দলের ক্ষমতাসীন নেতা-পাতিনেতারা বললেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করছে।’ ভাবখানা এই যে, এডিস মশার উৎপাদক হচ্ছে বিএনপি! স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ নিয়ে ব্লেমগেম না করার কথা বললেও এর অবসান হয়নি।

ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেখানে স্বার্থ, সুবিধা ও ব্যবস্থা একান্তই ঘরোয়া, সেখানে ব্লেমগেম বা একে অপরকে দোষারোপের বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু স্বার্থ যখন সমষ্টি নিয়ে, তখন এহেন দোষারোপের কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। বিশেষ করে, জাতীয় স্বার্থ যখন বিপন্ন, তখন দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে অভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা নিতে হয়। সেখানে যদি কোনো ব্যর্থতা থাকে তাহলে কার দায়দায়িত্ব এটা, তা নিরূপিত হতে হবে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। কিন্তু তাদের কার্যকলাপে ঘটে তার বিপরীত। তাই নাগরিক সাধারণের প্রশ্ন, ‘আমাদের দেশে সেই নেতা হবে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’?

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]