বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
শামীম আহমেদ
দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া শিক্ষিত তরুণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তরুণদের আড্ডায় এখন সব বিষয় ছাপিয়ে উঠে আসছে বিদেশ যাওয়ার বিষয়। দেশে ভালো বেতনের চাকরি ছেড়েও বিদেশমুখী হচ্ছেন অনেকে। ইংরেজি ভাষা শিখে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে চলে যাচ্ছেন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে। সেখানে গিয়ে আবারও উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হচ্ছেন। শিক্ষাজীবন শেষে থেকে যাচ্ছেন ওই দেশেই। নিয়ে যাচ্ছেন পরিবার। আবার দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে সেখানে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই এমন বিদেশমুখী তরুণের সংখ্যা বাড়ছে।
স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ গিয়েছেন বা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরি না পাওয়া, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, সুচিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি ছাড়া সেবা না পাওয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, দূষিত পরিবেশ, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করছে।
এদিকে ইউনেস্কোর ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছরই ৪০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। করোনার দুই বছর বাদে ২০১৫ সাল থেকে এই সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর শিক্ষার্থী যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে। সাম্প্রতিক সময়ে ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, সাইপ্রাস, ফিনল্যান্ডেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস নামে জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে প্রতি হাজারে তিনজন দেশ ছেড়ে বিদেশে অভিবাসী হয়েছিলেন। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে হাজারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার জন্য আগামী ৯ সেপ্টেম্বর স্ত্রীসহ দেশ ছেড়ে ফিনল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করবেন নাসিমুল আহসান। দেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরিও করতেন তিনি। ফিনল্যান্ড যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই বছর আগে আমার মেয়েটি মারা যাওয়ার পর বারবার মনে হয়েছে, উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে হয়তো ওকে হারাতাম না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা ওর আয়ু রাখেননি, তবুও বাবার মন তো মানতে চায় না। তখনই ভেবেছি এই দেশে আর থাকব না। অনেক খোঁজখবর নিয়ে ফিনল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের, বাচ্চার শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। চাকরি না থাকলে ভাতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারের। কেউ কারও পেছনে লাগে না। ভালো থাকতে জীবনে আর কী চাই? এদিকে আগামী বছরের শুরুতে স্ত্রীসহ কানাডায় পাড়ি জমাতে যাচ্ছেন মুহতামিম নাঈম। ভিসাও হাতে পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি দেশের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। চাকরি ছেড়ে কানাডা যাওয়ার ব্যাপারে নাঈম বলেন, ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতেই কানাডা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটা সুন্দর ও উন্নত জীবন দেওয়ার আশাও এর পেছনে জড়িত।
গত মে মাসে এমবিএ করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রাকিব হাসান। ডিগ্রি অর্জন শেষে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার ইচ্ছা তার। দেশে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে জার্মানি পাড়ি দেওয়া বৃষ্টি দে এখন দেশটির একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিদেশ গমনে এগিয়ে আছে। কারণ, বিদেশে পড়ার জন্য অন্যতম যোগ্যতা ইংরেজি দক্ষতা। এসব তরুণের বেশিরভাগ সেখানে গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে নেমে পড়েন উপার্জনে। কারণ বিদেশ যেতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়েছে। বিদেশে বাসস্থান এবং খাওয়ার খরচও নিজেকে বহন করতে হয়। ফলে তারা রেস্টুরেন্ট, হোটেল, হসপিটাল এবং সুপারশপে চাকরি করেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেকারত্বের কারণে অনেকে বিদেশ যাচ্ছেন। তবে বিদেশ গিয়ে যদি কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে সেটা খারাপ নয়। এটা তার জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। সে রেমিট্যান্স পাঠাবে। তবে সব মেধাবীরাই যদি বিদেশে পাড়ি দেয়, তাহলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্ভাবন দরকার। মেধাবীদের ফিরতে হবে। এ জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা ফিরলে যেন যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ ও সম্মান পায় সেই ব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারিভাবে করতে হবে। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ জন্য এখানকার ডিগ্রি নিয়ে অনেক দেশে গিয়ে ভালো চাকরি মেলে না। শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আনতে হবে। আমি ঢাবির উপাচার্য থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়টি র্যাংকের শীর্ষসারিতে ছিল। উচ্চ শিক্ষিতদের বিদেশমুখী মনোভাবের পেছনে বেকারত্বকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ-২০২২’ এর প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন।