দেশ কি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে

  • সুরঞ্জন ঘোষ
  •  ১৮ জুন ২০২৩, ২০:০০
দেশ কি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। – ছবি : সংগৃহীত

দেশের রাজনীতির অবস্থা সঙ্কটজনক। সাধারণ মানুষ সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে যারপরনাই শঙ্কিত। কী ঘটতে যাচ্ছে- এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তার শেষ নেই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব মহলে অনিশ্চয়তা বিরাজমান। বোঝা যায়, সরকার বিশ-দলীয় জোটকে বাদ দিয়েই একদলীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এর ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে তা তারা ভাবছে না। আমাদের রাজনৈতিক অবিবেচনা ও উন্নাসিকতা জাতির সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতিকে কোনো অনিশ্চয়তার অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে তা নিয়েও সরকারের ভাবনা নেই।

এসব বিষয়ে সবার আগে ক্ষমতাসীন দলেরই ভাবা উচিত এবং উদ্ভূত সমস্যা সমধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও তাদেরই নিতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক উন্নতিসহ সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। এ জন্য বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলের সাথে বসে যত দ্রুত সম্ভব আগামী নির্বাচনে অনুষ্ঠানে একটি যৌক্তিক সমাধানে আসতে হবে সরকারি দলকেই।

একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি হয়, দেশের অভ্যন্তরেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না, এমনকি দেশের বাইরে আমাদের যারা উন্নয়ন অংশীদার, তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য পাবে না। এ ধরনের নির্বাচন করতে গেলে নিশ্চিতই সঙ্ঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি হবে- যা কারো জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনবে না এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছাবে তা ভেবে অস্থির হই।

আমরা যতই যুক্তি প্রদর্শন করি না কেন, আমাদের যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক, সরকারের একগুঁয়েমি ও জেদ এত প্রবল যে, ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগে যেভাবে তারা কথা বলত, এখনো ঠিক সে রকমই কথা বলছে। অর্থাৎ তাদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না। ক্ষমতাসীন থেকে সরকারি দল নির্বাচন করবে এবং বিরোধী দল না এলেও যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হয়তো নির্বাচন হবে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওই নির্বাচন তো সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাও বিরোধী দলসহ বহুদলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান দেশে বিদ্যমান, তাদের প্রতিটি ভয়ঙ্করভাবে পলিটিসাইজড। দেশের মেধাবী অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পরিবর্তে দলীয় অনুগতদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত বলে অভিযোগ আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন যেমনটি হয়েছিল, অর্থাৎ কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে এবং কোনো কোনো কেন্দ্রে ৯৪-৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। ১৯৯৬ সালে মোট ভোটদাতার হার ছিল ৮৭.১৩। শতভাগ মানুষ ভোট দেবে তা কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। এ দেশের মানুষ এখন যে এত নির্বোধ হয়নি তা-ও আমাদের রাজনীতিকরা কখনো অনুধাবনে আনেন না।

রাজনীতিকদের প্রতি এখনো আস্থা আছে। তারাই পারেন সমূহ সঙ্কট কাটিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে জাতিকে আলোর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে। তবে অনিশ্চয়তার রাহু জাতিকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই তাদের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটতে হবে। জাতি সেদিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু এখনো দুই জোটের মধ্যে অনিশ্চয়তা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস এত উঁচু মাত্রার যে, এরকম অবস্থায় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প আছে কি?

রাজনীতিকদের ব্যর্থ নেতৃত্ব দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সময়ে আমরা দেখেছিলাম সব কিছু তছনছ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সৃষ্টির আন্দোলনে ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছিলেন, হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তখন, কয়েক হাজার মানুষ পঙ্গু হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই সরে দাঁড়াননি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে। দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের জন্য বিরোধী দল তখন অনেক কিছুই করেছে। ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর নিজের দলের এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলেমিশে তারা পদত্যাগ করে। এ কারণে তখনো দেশে একটিনো গভর্নমেন্ট বা নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। বাধ্য হয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী সেই বির্তকিত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সবাই সাগ্রহে মেনে নিয়েছিলেন এই ব্যবস্থা।

কারো বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ নেই। শুধু একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই- যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হলো, কোনো বিকল্প তৈরি না করে তত্ত্বাবধায়কের এই ব্যবস্থাটিকে ছুড়ে ফেলার যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা কী? বলবেন, আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য এটি করা হয়েছে। কিন্তু আদালত তো রায়ে স্পষ্টভাবে বলছিলেন, এই ব্যবস্থা দশম এবং একাদশ সংসদ গঠনের জন্য কার্যকর করা যেতে পারে যদি সংসদ রাজি হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আদালতের পূর্ণ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা রহিত করেন। একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা পরিবর্তনের আগে জনমত যাচাইয়েরও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। বিরোধী দল আস্থায় গ্রহণ করেনি। তাই এই সঙ্কট। এই সঙ্কট নিয়ে জাতি উদ্বেগাকুল। চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে হতাশা। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না, আদপে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?

দেশের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতবিদরা কাজ করেন। তাদের ভুলের কারণে দেশের মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। আমরা এখন এ রকম একটি বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি। এ অবস্থা থেকে যত দ্রুত সম্ভব, মুক্তি চায় সাধারণ মানুষ। কেননা, ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ বেড়েছে। যদিও এ অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্ত করার ক্ষমতা বর্তমান সরকারের আছে। সমস্যা সমধানে সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে, রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, মাত্র ৫১ বছরের মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনস্বার্থ সম্পর্কে এত নিস্পৃহ হতে পারে এবং এত নিরাসক্ত ও নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে এত বেশি সচেতন তা ভেবে দেশের অভ্যন্তরে শুধু আমরা কেন, আমাদের বিদেশী বন্ধুরাও অস্থির হয়ে ওঠেন।

আমাদের রাজনীতিকদের অহংবোধ এতই প্রবল এবং ক্ষমতাপ্রীতি এত মারাত্মক যে, তারা আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। সময় হয়তো আসবে, এই সঙ্কটে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করবে। রাজনৈতিক নেতাদেরকে বাধ্য করবে সমস্যা সমাধান করার জন্য।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল দীর্ঘদিন ধরে জোরেশোরে বলে আসছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশের সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দেশে বর্তমানে যে দু’টি রাজনৈতিক জোট বিদ্যমান, তাদের পারস্পরিক বিদ্বেষ, অনাস্থা, অবিশ্বাস এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করতে হবে এমন এক ব্যবস্থা, যা নিরপেক্ষতার প্রতীক অথবা পক্ষপাতহীন। প্রথমে এ দাবি ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের। এখন এ দাবি জনতার। বিশিষ্টজনদের। বুদ্ধিজীবী মহলের। সব গণতন্ত্র ব্যক্তির। এ দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন করলে তা হবে এক প্রহসন। জাতীয় পর্যায়ে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এরও কারণ রয়েছে। যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য তাদের নির্ভর করতে হবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো দলীয়করণের ফসল।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীতে রয়েছে বিশেষ এলাকার বিশেষ দলের উল্লেখযোগ্য দলীয় কর্মী। কালো টাকার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দুদক সম্পূর্ণ অপারগ। তাদের কেউ অপরাধ করলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার কোনো বিচার হবে না। এসব কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠা বা সংলাপের মাধ্যমে কোনো বোঝাপড়া ছাড়া সাধারণ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। জনগণ ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুব্ধ। পুলিশ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র প্রতিরোধ ঠেকাতে পারেনি বিক্ষুব্ধ মানুষকে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে রাজপথে জনতা।

আশা করব, আমাদের রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সাধারণ দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী শিগগিরই তারা উদ্যোগ নেবেন। দেশের রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রে এখনো তো যোগ্য ও দেশপ্রেমিকদের স্থান হচ্ছে না। লোভী, দুর্নীতিবাজ, বিদেশে টাকা পাচারকারী ও রাজনৈতিক ষণ্ডাপাণ্ডারাই বসে আছে রাজপথে। এ অবস্থায় অবসান হওয়া উচিত।

কলামিস্ট : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যর কেন্দ্রীয় সাবেক ছাত্রনেতা