- এম এ করিম
- ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:৪৭
১. দেশের বৃহত্তম জনপ্রিয় বিরোধী দল বিএনপিসহ সব বিরোধী দল নির্বাচনকালীন পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক নিরপেক্ষ সরকার অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সোচ্চার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করার পর বিগত এক যুগব্যাপী দেশ থেকে গণতন্ত্র উধাও হয়ে গেছে। গণতন্ত্রকে দেশ থেকে সমূলে বিদায় করে দেশে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনে দেশ শাসিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা সংবিধানে সংযোগের দাবিতে অগ্রণী ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা। মূলত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা সংযোজনের জন্যই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার প্রয়োজনে। তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা সংযোজনের পর ওই বছরই জুন মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধীনে আবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতাসীন হয়। তার পর ২০০৮ সালে অনেকটা তদ্রুপ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদলে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, তাদের জোট, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। উল্লিখিত তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল।
২. মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতার চালিকাশক্তি ছিল গণতন্ত্র। সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রত্যক্ষ ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকাতে সংসদ অধিবেশনের দিনক্ষণ ধার্য করে এবং তা স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের ব্যালটের মর্যাদার রক্ষার্থে রাজপথে নেমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ।
৩. মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চালিকাশক্তি ছিল গণতন্ত্র। তারই ধারাবাহিকতা বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চার স্তম্ভের অন্যতম ছিল গণতন্ত্র। ১০ জানুয়ারি ৭২ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে মুজিবনগর সরকারের ফর্মুলায় দেশ স্বাধীনতার এক বছর কাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তা মেনে নেয়নি। ১২ জানুয়ারি ’৭২ তিনি প্রেসিডেন্ট পদটি নয় প্রধানমন্ত্রীর পদটিই গ্রহণ করেন। পৃথিবীতে দেশ শাসনের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির সরকারের ফর্মুলার সরকার থাকলেও গণতন্ত্রের ফর্মুলাই অধিক সমাদৃত এবং রাজাসনে মহিমান্বিত। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে একদলীয় বাকশাল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ১৫ আগস্ট ’৭৫ এক মর্মান্তিক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবার- লোকজনসহ নিহত হন। উল্লিখিত মর্মান্তিক ঘটনার তাৎক্ষণিক পরিবর্তনে বাকশাল শাসন চির বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু তার পরও সংসদীয় গণতন্ত্র দেশে ফিরে আসেনি। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানও চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন। জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছর গণতন্ত্রের বিপরীতে স্বৈরশাসনে দেশ শাসন করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। হারানো গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্যই সম্মিলিত বিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদকে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তখনকার পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন ক্ষমতাসীন হলে নিরপেক্ষ সরকারের আদলে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত এবং তারই শাসনামলের প্রারম্ভে দেশে হারানো সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। অর্থাৎ মূলত ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৯০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ বছর দেশে দৃশ্যমান কোনো গণতন্ত্র ছিল না। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল শতভাগ সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা সংবিধানে স্থান নেয়ার ফলেই ১৯৯৬ সালে জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে পেরেছিল। তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা সংবিধানে সংযোজন দেশের জন্য শতভাগ উপযোগী যার দরুন ওই ফর্মুলা দেশে স্থায়ী রূপ পাওয়া দেশের মাটি ও জনগণের অন্তর্নিহিত চাহিদা।
৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে সংবিধান থেকে বাতিল করার ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে গণতন্ত্রের যবনিকাপাত ঘটে। দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারের পর্যায়ে ক্ষমতাসীন সরকার দৃশ্যমান স্বৈরাচার এবং কর্তৃত্ববাদী হতে পারা, গণতান্ত্রিক বিশ্বে এটি এক নজিরবিহীন ইতিহাস। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করেই ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাসীন থেকে এবং সংসদ বহাল রেখে নিজেদের ইচ্ছামাফিক সংসদ নির্বাচনের নামে ৯ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন থেকে, প্রধানমন্ত্রীসহ অপরাপর মন্ত্রীরা ‘তাদের শাসনামলে গণতন্ত্র নিরাপদ এবং দেশে গণতন্ত্র বিরাজ করছে’, মর্মে অসত্য শোরগোল করে যাচ্ছেন। নেপথ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে সংসদ নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকরা অনুধাবন করতে পেরেছে, জনগণের ভোটাধিকার থাকলে আবার তারা বিরোধী দলের অবস্থানেই থাকতে হবে, ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়; মূলত তার প্রেক্ষাপটে সংবিধান থেকে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযোজন বিলুপ্তি, পরে ভোটারবিহীন সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বিলুপ্তির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন যা ছিল তাদের ভ্রমাত্মক ধারণা। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সামরিক স্বৈরশাসক। সংসদীয় পদ্ধতির ক্ষমতাসীন সরকার স্বৈরাচার অপবাদ নেয়া তাদের জন্য রাজনৈতিক অপমৃত্যু। দ্বাদশ নির্বাচনে উক্তরূপ অপবাদ থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।
৫. গণতন্ত্রকে দেশে ফিরে আসতে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা সংবিধানে সংযোজনে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিকল্প কিছুই নেই। স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত করার প্রারম্ভিক রাজনৈতিক কৌশল বিচার বিভাগকে ক্ষমতাসীনদের দলীয় আদলে নিয়ন্ত্রণ করা। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা দেশে বিদ্যমান থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা অসম্ভব। তারই ধারাবাহিকতা বিরোধী আন্দোলন দমানোর এবং বিরোধী নেতাদের কারাগারে রাখা, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে উক্তরূপ অসাধ্য কাজটি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈরসরকার যার দরুন গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন হয়ে যায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নামান্তর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে রাখা মামলা, হামলা, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখার এক সহায়ক ফর্মুলা। উন্নয়নের নামে চলে দেশে ক্ষমতাসীনদের অবাধ দুর্নীতি। গণতন্ত্রবিহীন অবস্থার দরুনই দেশে চলছে ক্ষমতাসীনদের অবাধ অরাজকতা।
৬. দেশের প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল দেশে হারানো গণতন্ত্র ফিরে পাওয়াসহ দেশে Mal administration, ক্ষমতাসীনদের নজিরবিহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার পদত্যাগের, সংসদ বিলুপ্তির দাবিতে গণ-আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার। অন্য দিকে ক্ষমতাসীনরা জনতার দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা দাবি মেনে নেবে না, তারা সংবিধান মোতাবেক দ্বাদশ নির্বাচনের ব্যাপারে অটল। তারা সংবিধান, ইতিহাস বেমালুম ভুলে গেছে তাদের হীন স্বার্থকে বলবৎ রাখার জন্য। সংবিধানে সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা সংযোজন হয়ে গেলে তাই সংবিধান। ক্ষমতাসীন সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার, তারা ইচ্ছা করলে দেশে এক দিনের মাধ্যমে সংবিধানে জনতার দাবি তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা সংযোজন করে তারা নিজেরা ও নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে তাদের জয়-পরাজয়ে কিছুই আসে-যায় না, পরবর্তীতে তারা তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলাতে পুনঃ ক্ষমতাসীন হওয়ার তাদের থাকবে উজ্জ্বল সম্ভাবনা, দেশ পাবে গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতিরেকে দ্বাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপরীতে অবস্থান করছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দ্বাদশ নির্বাচন বর্জন করলে ‘১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মতো এর কলঙ্কজনক ভোটারবিহীন নির্বাচনই হবে। বিকল্প পন্থায় সরকারের একগুঁয়েমি অবস্থানে দ্বাদশ নির্বাচনের আগেই দেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনার আধিক্য।
লেখক : কলামিস্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের সিনিয়র আইনজীবী