সাঈদ ইফতেখার আহমেদ
মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যারা বিশ্ব-ইতিহাসকে দেখেন, তারা মনে করেন, সভ্যতার সূচনালগ্নে উৎপাদন কাঠামো আদিম হওয়ার কারণে সেখানে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হতো না। এই মূল্য তৈরি না হওয়ার ফলে সমাজে কোনো শ্রেণি কাঠামো গড়ে ওঠেনি। শ্রেণি না থাকার ফলে কোনো ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মানুষ সে সময় সমতাভিত্তিক জীবন যাপন করত। এ ধরনের সমাজব্যবস্থাকে কার্ল মার্ক্স ‘আদিম সাম্যবাদী’ সমাজ বলে অভিহিত করেছেন।
এ সমাজে সব মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমান থাকার ফলে কোনো অসম রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত আদিম ধরনের গণতান্ত্রিক নিয়মে পরিচালিত হতো। ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসন আদিম সাম্যবাদী সমাজে দেখা যায়নি। মার্ক্সের বিশ্ববীক্ষার তত্ত্ব অনুযায়ী, উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে সমাজে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হতে থাকে, যার থেকে শ্রেণি কাঠামো গড়ে উঠে সমাজকে শ্রেণিতে বিভাজিত করে। বস্তুত এ শ্রেণি বিভাজন সভ্যতার সূচনালগ্নে কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বের জন্ম দেয়। যদিও এ নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রসহ নানা নামে পরিচিত ছিল, কিন্তু শাসন পদ্ধতির মূল ধরনটা ছিল একই। অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদী।
এ বিকাশের ধারায় মধ্যযুগ-পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ইউরোপের দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এর ধারাবাহিকতায় পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও নারীসহ সমাজের অনেকের ভোটাধিকার না থাকার ফলে বর্তমান সময়ের তুলনায় তা ছিল সীমিত ধরনের গণতন্ত্র। বিভিন্ন ঘরানার মার্ক্সবাদী ও বামপন্থিরা একে গণতান্ত্রিক শাসন না বলে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন বলে অভিহিত করেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আরও বিকশিত হয়। নারীসহ সমাজের সব অংশের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘আইরনি,’ সে ধরনের বিষয় আমরা লক্ষ্য করি এসব সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাঝে। অনেকটা মধ্যযুগীয় কায়দায় এসব রাষ্ট্র এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে।
এসব উপনিবেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারেকাছে না গিয়ে কর্তৃত্ববাদী বা চরম অগণতান্ত্রিক কায়দায় শাসন বজায় রাখে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সময়ে ইউরোপের নানা দেশে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ, সর্বাত্মকবাদ, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় শাসন, স্বৈরশাসন, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম– নানারূপে কর্তৃত্ববাদী শাসন বিস্তার লাভ করে।
এসব কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের কোনো কোনোটিতে এক ধরনের নির্বাচন এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি ছিল। যেমন পূর্ব ইউরোপের কিছু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একাধিক ছোট দল ছিল। তারা নির্বাচনেও অংশ নিত। কয়টি আসনে তারা নির্বাচন করবে এবং কতটি আসন তারা সংসদে পাবে, তার সবকিছুই নির্ধারিত হতো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দ্বারা। এসব রাজনৈতিক দলের কাজ ছিল ক্ষমতাসীন দলের লক্ষ্য, কর্মসূচি ও এজেন্ডা সমর্থন করা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে সাফাই গাওয়া।
পূর্ব ইউরোপের পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নেও নির্বাচন হতো। তবে সে নির্বাচনে একটি দল থেকেই কয়েকজন প্রার্থী হতেন। এর বাইরে স্বতন্ত্রভাবে তারাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন, যাদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচন করার অনুমতি দিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে পরিচিত ব্যবস্থা পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে অবসান হওয়ার পর সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের ধারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রের ধারণা শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার রাশিয়াতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধরনের পরিবর্তন ঘটে; বিশেষত পুতিন ক্ষমতায় আসার পর। সরাসরি কর্তৃত্ববাদী শাসন আইনগত, নৈতিক এবং মূল্যবোধগত কারণে দুরূহ হওয়ার ফলে গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসন বজায় রাখার ফর্মুলা তিনি শক্তভাবে রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বে ‘পুতিনবাদ’ নামে পরিচিত।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের উপাদানগুলো আপাত দৃশ্যমান। যেমন এক ধরনের মুক্ত গণমাধ্যমের উপস্থিতি, শক্তিশালী বিরোধী দল, রাষ্ট্র এবং সমাজের অনেক বিষয় নিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত আকারে হলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল এবং এর নেতাকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। আবার নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নির্বাচন সঠিক না হওয়া, নির্বাচনে কারচুপি; এসবের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভও দেখা যায়। কিন্তু কোনো কিছুই একজন শাসককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর ধরনে পরিবর্তন সাধন করে না। পুতিন তাঁর ভাষায় এ ধরনের গণতন্ত্রকে ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রতিটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেমন হবে, এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ বিষয়ে বাইরের কোনো রাষ্ট্রের কথা বলার কোনো অধিকার নেই।
পশ্চিমা দুনিয়া যাদের ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলে, সেসব উন্নয়নশীল দেশের অনেক কর্তৃত্ববাদী শাসকের কাছে পুতিনবাদ এবং তাঁর ‘সার্বভৌম গণতন্ত্রের’ ধারণা বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। এসব রাষ্ট্রের অধিকাংশই ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সময় এসব রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ঔপনিবেশিক শাসকদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপরীতে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই কর্তৃত্ববাদী শাসক হওয়ার ঝোঁক এসব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় বলে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন। ১৯৭১ সালে উদারনৈতিক গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সাম্য আর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা তথা সেক্যুলারিজমের কথা বলে মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত হলেও, দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছু পরেই অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বের মাঝেও গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে কর্তৃত্ববাদী পন্থায় শাসন করার ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সরকারি ও বিরোধী নেতৃত্বের মাঝে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা, চর্চা এবং মূল্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি বর্তমানে দৃশ্যমান।
একদলীয় শাসন, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতা পেরিয়ে পুতিনবাদী ধারায় গণতন্ত্রের মিশেলে কর্তৃত্ববাদী শাসন পরিচালনা করার দিকে বর্তমান শাসক শ্রেণির ঝোঁক অনেকটাই স্পষ্ট। অন্যদিকে বিরোধী রাজনীতি যারা করছেন, তারাও উদারনৈতিক গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিষয়ে তাদের কমিটমেন্ট জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে পারেননি। ফলে কর্তৃত্ববাদী ধারায় শাসনের যে সংস্কৃতি, তার একটি প্রবল উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে।
এ ধারাকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজটি এ দেশের কোনো রাজনৈতিক দল এখনও বিশ্বাসযোগ্যভাবে করে উঠতে পারেনি। ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির হেজেমনিক বা প্রাধান্যশালী উপস্থিতি সমাজ কাঠামোতে অনুপস্থিত। গণতন্ত্র বলতে প্রায় সব দলের রাজনৈতিক কর্মী এখনও তাদের দল ক্ষমতাসীন থাকা বা তাদের নেতাদের নির্বাচিত হওয়া বোঝেন।
বস্তুত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারার ব্যর্থতা থেকেই কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সমাজে ক্রমশ জেঁকে বসছে। এ ধারার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রাজনৈতিক দলগুলো এবং সিভিল সোসাইটি যদি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে গিয়ে অনেকটা পুতিনবাদী ধারায়, কর্তৃত্ববাদী শাসনের নিগড়ে দেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঁধা পড়তে পারে।
ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ: শিক্ষক, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র