‘বাংলাদেশে স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনের ফল থেকে গতকাল রোববার এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী জুনের মধ্যে প্রকাশ করা হতে পারে।
গড় আয়ু বাড়াকে উন্নয়নের লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিষয়টিই এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। বিগত বছরগুলোতে বিবিএসের এ-সংক্রান্ত উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিবছর গড় আয়ু বাড়ার প্রবণতা আছে। এবারই তা কিছুটা কমলো। অবশ্য, প্রকল্প পরিচালক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ৭২ দশমিক ৪ বছর থেকে ৭২ দশমিক ৩ বছরকে প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমছে বলা যাবে না, বরং স্থির রয়েছে বলা যায়। গড় আয়ুর গত ৩ বছরের প্রবণতায় দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর।
এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের আওতায় জরিপটি চালানো হয়েছে। গত জানুয়ারিতে সারাদেশের ২ হাজার ১২টি নমুনা এলাকার প্রায় ১৩ লাখ মানুষের কাছ থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবেদনটি স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্টেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) নামে পরিচিত। এটিকে বিবিএসের মৌলিক জরিপগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে জনমিতির ১৩৮টি সূচকের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২৭ সূচক এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ১৭টি সূচকের তথ্য-উপাত্ত।
প্রতিবেদনে মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গড় আয়ু কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া। বিবিএসের নতুন প্রতিবেদন বলছে, প্রতি হাজারে মৃত্যুর হার বেড়ে এখন ৬ দশমিক ১ জন; যা আগের দুই বছর ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮ এবং ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। মৃত্যুর বড় ১০ কারণের মধ্যে প্রথমে রয়েছে হার্ট অ্যাটাক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। জরিপ প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন।
শিশুমৃত্যু বেড়েছে, কমেছে মাতৃমৃত্যু
প্রতিবেদেনে দেখা যায়, বেড়েছে সব বয়সী শিশুর মৃত্যু। এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে এখন ২৭ জন, যা আগের দুই বছরে ছিল ২৪ ও ২২ জন। এক মাসের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু প্রতি হাজারে ২০ জন, যা আগের দুই বছর ছিল ২০ জন করে। এভাবে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুও বেড়ে এখন ৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছর ছিল প্রতি হাজারে ৩১। অবশ্য, মাতৃমৃত্যু কিছুটা কমেছে। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৩৬ জনে নেমে এসেছে, যা গত বছর ছিল ১৫৩ জন।
জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার
গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে জনংসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার। এবারও নারীর সংখ্যা বেশি। মোট জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার, আর পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার। প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের বছর ছিল ১ দশিমক ৪ শতাংশ। জনঘনত্ব অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১৭১ জন বাস করছেন।
বেড়েছে সাক্ষরতা
দেশে সাক্ষরতার হার বেশ বেড়েছে। জরিপে গত বছর সাক্ষরতার হার পাওয়া গেছে ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ। সাত বছরের বেশি বয়সের জনসংখ্যাকে সাক্ষরতায় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে এ হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৭৪ দশমিক ৪ জন। অর্থাৎ সব বয়সীর মাঝেই সাক্ষরতার হার বেড়েছে।
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ
প্রতিবেদন বলছে, এখন কোনো ধরনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই এরকম তরুণের হার ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অবশ্য আগের বছরের চেয়ে এ হার কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালে এ ধরনের তরুণের হার ছিল ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তরুণদের চেয়ে তরুণীদের মধ্যেই এ হার বেশি। প্রতিবেদন বলছে, এ ধরনের তরুণীর হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যদিও আগের বছরের চেয়ে তা কিছুটা কমেছে। আগের বছর এ হার ছিল ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৪ বছরের বয়সসীমাকে তরুণ বা তরুণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বেড়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার
বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই। ২০২২ সালে ইন্টারনেট ব্যবহার করত দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামেও এ হার বেশ বাড়ছে। আগের বছরের ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে গ্রামে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। শহরে ৫৪ থেকে এখন ৫৭ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবাহর করে থাকে। অন্যদিকে মোবাইলে ফোন ব্যবহার খুব একটা বাড়েনি। প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে ৭৪ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে, যা আগের বছর ছিল ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে ধর্ম এবং নৃতাত্ত্বিক বিন্যাসে দেখা যায়, দেশে মুসলমানের হার কিছুটা বেড়েছে। ২০২৩ সালের হিসাবে এ হার ৮৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৮৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের হার ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
জনসংখ্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নুরুন্নবী মনে করেন, মৃত্যু হার বেড়ে যাওয়ার কারণেই আগের বছরের চেয়ে প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে। তবে দুই বছরের মধ্যে যতটুকু তফাৎ, তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আগামীতে হয়তো আবার গড় আয়ু বেড়ে যাবে, মৃত্যু হার কমে আসবে।
সমকাল