রেজাউল করিম রনি
স্বাধীনতা এমনকি একটি জটিল ধারণা যা নিয়ে গভীর দার্শনিক চিন্তার অভাব নাই। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতা এক বিপুল আবেগ জাগানিয়া শিহরণের মধ্যে আটকে থাকার কারণে এই বিষয়ে চিন্তাশীল আলাপ কমই উঠতে দেখা যায়। আবার বেশির ভাগ সময়ে বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আলাপ উঠলেও তা মৌসুমি হাওয়ার মতো আসে আবার মিলিয়ে যায়। কিন্তু স্বাধীনতা একটা প্রতিদিনের সংগ্রামের বিষয়। প্রতিনিয়ত মানুষের অস্তিত্বের বোধ ও সত্যের সঙ্গে স্বাধীনতার মীমাংসা করেই জীবন পরিচালনা করতে হয়। কাজেই বিষয়টার গুরুত্ব যতটা দার্শনিক বা তাত্ত্বিক ভাবে থাকার কথা তা আমরা আমলে না নেয়ার ফলে এটাও দায়সারা আনুষ্ঠানিকতাতে শেষ হয়ে যায়। আমরা স্বাধীনতার দুটি দিক নিয়ে অতি সংক্ষেপে এই লেখাতে কিছু কথা বলবো আজকে।
ক.
ভারতের বিখ্যাত ‘ফ্রন্টলাইন’ ম্যাগাজিন তাদের দেশের স্বাধীনতার ৭০ বছর উপলক্ষে বিশেষ লেখালেখি নিয়ে একটা সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। তার একটা লেখার উপর দৃষ্টি ফেরাতে চাই। আমার পছন্দের সমাজ তাত্ত্বিকদের একজন- গোপাল গুরু। আগেও তার লেখালেখি দেখেছি। চলতি সমস্যা নিয়ে দার্শনিক আলাপের দক্ষতা খুব বেশি চিন্তকের থাকে না। বাংলাদেশে তো হাস্যকর সব কমেনটেটর/কলামিস্ট। করপোরেট কোম্পানি, মিডিয়া, তারকারাই স্বাধীনতার স্বাদ তৈরিতে চেষ্টা করেন। আর তারা যত সক্রিয় হয় জাতি আরও পরাধীন হতে থাকে। যাই হোক গোপাল মজার এবং বাস্তব প্রবণতার তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কথা বলেছেন- স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। আমি সহজ করে বাংলাতে তার ভাবনার আলোকে এখানে কিছু কথা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। তিনি বলছেন, ‘স্বাধীনতা’ কথাটার গুরুত্ব এবং অর্থ একটি জাতির জীবনে সব সময় একই অর্থ/মিনিং নিয়ে টিকে থাকে না। ‘স্বাধীনতা’র সিগনিফিকেন্স/গুরুত্ব চেঞ্জ হয়। যেমন, উপনিবেশ থেকে মুক্তির সংগ্রামের কালে ‘স্বাধীন’ হওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য ছিল। উপনিবেশ বা অপরের শাসন থেকে মুক্তিই ‘স্বাধীনতা’-এমন ধারণা তখন প্রধান থাকে। কিন্তু মুক্তির পরে? দেশ অপরের শাসন থেকে মুক্তি লাভের পরে, স্বাধীনতা বলতে যেটা বুঝায় তা হলো- ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা।’ এই রাজনৈতিক স্বাধীনতাই আসলে স্বাধীনতার মূল সিগনিফিকেন্সে/গুরুত্বে পরিণত হয় জাতির জীবনে। তিনি আরও যোগ করেন, এই রাজনৈতিক স্বাধীনতাই দেশ গঠনের হরেক রকম পরিভাষা জনগণের মধ্যে তৈরি করে। আর এই সব পরিভাষার ‘রেটরিক্যাল’ বা বাক্যসর্বস্ব ব্যবহার দেখা যায় ক্ষমতাসীনদের মাঝে। যেমন, মেইক ইন্ডিয়া (আপনারা পড়ুন- ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়ন, চেতনার বাংলাদেশ-নির্মাণ)।
(দলিত: ইন এ স্ট্যাইট অব আন-ফ্রিডম-গোপাল গুরু, পৃষ্ঠা-৭৩, ফ্রন্টলাইন)
খ. এখন আমাদের অবস্থা যদি দেখেন। ‘স্বাধীনতা’ বলতে আমরা যা বুঝি! যেই চিন্তার কাঠামোতে আমারা ‘স্বাধীনতা’ বিষয়টা বিচার করি তা অতি অকেজো, তাতে আর কাজ চলে না। আমরা সেই ’৭১ সালের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের অতি প্রাথমিক উত্তেজনার মধ্যে আটকে আছি এখনো। স্বাধীনতা ও ’৭১-এর বিষয়টার ব্যাপারে আমাদের বুঝ সিনেমাটিক। ক্ষণিক উত্তেজনাতে মাতি। দিবস নিয়ে বিজি থাকি।
পাকিস্তান থেকে রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার জন্য যে সংগ্রাম ও পরীক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়, তার কোনো কার্যকর পরিবেশ তৈরি করতে পারি নাই। বরং পাকিস্তানের পথেই হেঁটেছে দেশে।
আওয়ামী লীগ হুট করে আজকের এমন অবস্থায় আসে নাই। এর ইতিহাস জাতির জন্মের সঙ্গেই সম্পর্কিত। আমরা আমাদের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে ’৭১-এর আবেগে ভেসে গিয়েছি এত কাল। যা বলাই বাহুল্য কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের ধারে কাছে নাই।
যে দেশে ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ থাকে না সেই দেশে আর কোনো ধরনের স্বাধীনতারই কোনো মূল্য থাকে না। ফলে আমাদের দেশেও সাধারণ মানুষের কাছে, শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের কাছে স্বাধীনতা কথাটার কোনো মানে থাকে না। কারণ এই দেশে অবস্থার পরিবর্তন হয় নাই। সম্মান
বাড়ে নাই। সততার সঙ্গে টিকে থাকার সুযোগ বৃদ্ধি হয় নাই। বরং প্রতিটি স্তরে দেখেছে নোংরা প্রতিযোগিতা। কালোটাকা, ক্ষমতার দম্ভ ও নানান ভাবে অত্যাচার ও শোষণের মধ্যেই তাকে থাকতে হচ্ছে। তার কাছে স্বাধীনতার কোনো মর্ম থাকার কথা না।
স্বাধীনতার নামে অনুষ্ঠান আয়োজনের মাত্রায় গিয়ে যারা স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণ করে দিতে চান তাদেরকে জনশত্রু হিসেবে চিনতে সাধারণ মানুষের ভুল হয় না। বরং রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নকে আড়াল করতেই সেই অতীত কালের স্বাধীনতার কথা বা আমরা স্বাধীন এমন বয়ান বেশি বেশি প্রচার করা হয়। এইসবের মধ্যদিয়ে আসলে গোটা জাতিকে রাজনৈতিক ভাবে আরও পরাধীন করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা এগুলো নিয়ে ক্রিটিক্যালি কথা না বলে দলীয় বয়ানের ক্যানভাসার হয়ে ওঠে- তখন এটা আরও সমস্যা তৈরি করে। ’৭১-এর মুক্তির লড়াইয়ের ইভেন্ট থেকে ‘স্বাধীনতা’কে আলাদা করে দেখবার চোখই তৈরি হয় নাই আমাদের। অতীতের গৌরব অতীতে থাকবে। সেটা কেউ নিয়ে নিবে না। নিতে পারবে না। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটি হলো স্বাধীনতার মূল প্রশ্ন।
বাংলাদেশ কেন আলাদা হতে চেয়েছিল? একটা আলাদা নাম পাওয়ার জন্য না। বরং রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন মনে করতো না এই দেশের জনগোষ্ঠী।
দেশকে অন্য দেশের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা একটা প্রাথমিক কাজ। এটা বুনিয়াদ। শুরু মাত্র। কিন্তু মূল কাজ হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এটা নিশ্চিত করা না গেলে ভূখণ্ডগত ভাবে আলাদা নাম, পতাকা নিয়ে বেড়ে উঠলে এক শ্রেণির লোক প্রভু, শোষক হবে আর বিপুল মানুষ দাস বা শোষিত হবে-এটাই স্বাভাবিক। মানে আলাদা হওয়ার বা ভূখণ্ডগত স্বাধীন হওয়ার কোনো অর্থ তৈরি হবে না। ভূখণ্ডগত ভাবে স্বাধীন হওয়ার বিষয়টা তখনই অর্থপূর্ণ হবে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে।
এই বিষয়ে কোনো বিতর্ক নাই যে, আমরা এখনো রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। মানুষকে আজও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ভয়ে থাকতে হয়। অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতার তর্কটি সামনে আনাই এই মুহূর্তে জরুরি কাজ। এটা অর্জিত না হলে ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার কোনো মর্যাদা থাকে না। থাকা সম্ভব হয় না।
manabzamin