১৮ মে, ২০২৩ techshohor.com
আল-আমীন দেওয়ান : একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের মোবাইল কারখানারগুলোর উৎপাদন।
চলতি মাসের শুরু হতে এখন পর্যন্ত ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ কারখানার মোবাইল উৎপাদন। উদ্যোক্তারা বলছেন, মোবাইল ফোন সংযোজনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি যন্ত্রাংশ আমদানির পরও কাস্টমস হতে তা ছাড় করতে পারছেন না তারা।
অন্যদিকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে, মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিপিসি সুবিধার অপব্যহার করেছে।
তবে দেশীয় কারখানাগুলোতে এভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে খাতটির বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিতে পড়া, বিপুল কর্মী ছাঁটাই, বাজারে ‘অবৈধ ফোনে’ সয়লাভ হয়ে যাওয়া, সরকারের রাজস্ব হারানোসহ এ খাতে বিপর্যয় তৈরি হতে পারে বলে বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশে মোবাইল কারখানা স্থাপনকারী উদ্যোক্তারা।
দেশে কারখানা করা উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ডগুলো হলো স্যামসাং, আইটেল-ট্র্যানসান, নোকিয়া, শাওমি, সিম্ফনি, ফাইভস্টার, লাভা (বর্তমানে বেনকো), উইনস্টার, ভিভো, অপো, রিয়েলমি, ওয়ালটন, লিনেক্স, আরএফএল, মাইসেল, ডিটিসি।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ( এমআইওবি) সাধারণ সম্পাদক এবং এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শাহিদ টেকশহর ডটমককে জানান, ‘খুবই খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘বিষয়টি নিয়ে কাস্টমস হাউজে অ্যাসেসমেন্ট কমিটি হয়েছে । কমিটি আমাদের যুক্তি শুনে, ব্যাখ্যা শুনে ওনারা এগ্রি করেছে, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে দুই জায়গাতেই। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর একমত হতে পারছে না বলে বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না, এখনও আটকা আছে।’ বলছিলেন তিনি।
এমআইওবি’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এখন ৯৯ পারসেন্ট কম্পোনেন্ট রিলিজ করা হলো আর ১ পারেসেন্ট না রিলিজ হলো তাহলে তো প্রডাক্টশন হবে না। আমাদের শত শত কোটি টাকার প্রডাক্ট প্রায় রেডি পড়ে আছে, একটা বা দুইটা কম্পোনেন্টের জন্য প্রডাক্টটি পুরোপুরি তৈরি করতে পারছি না। এটা বড় হ্যাসেল, ব্যাংক ইন্টারেস্ট হচ্ছে, মার্কেটে দিতে পারছি না। এই সুযোগে কিন্তু গ্রে মার্কেট অ্যাগ্রেসিভ হচ্ছে, তাদের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে, ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিকে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে।’
জাকারিয়া শাহিদের এডিসন গ্রুপ হতে দেশে সিম্ফনি ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট তৈরি হয় । গ্রুপটি তাদের সিম্ফনির কারখানায় মটোরোলার হ্যান্ডসেট তৈরিতেও চুক্তিবদ্ধ।
এই উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘এতোগুলো ফ্যাক্টরির এই অবস্থা, আমরা কতো জায়গায় কতোবার ভিজিট করেছি। কিন্তু কেউ ওনারশিপ নিচ্ছে না। আমরা অনিশ্চিতের মধ্যে আছি। র ম্যাটেরিয়ালসের কারণে যদি আমাদের প্রডাক্টশন বন্ধ থাকে তাহলে তো কারখানার কর্মীদের ছুটি দিয়ে দিতে হবে। তখন কর্মীরা ভাববে তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, তারা আন্দোলন করে বসতে পারে। আমাদের নানা ডেমারেজ হচ্ছে ।’
দেশে স্যামসাং মোবাইল ফোনের উৎপাদক ও বিপণনকারী ফেয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্স ।
ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন টেকশহর ডটকমকে জানান, ‘এই ইস্যুতে যতো কমপ্লায়েন্স আছে আমরা সবকিছু ফেইস করেছি। আমরা এনবিআরকে জানিয়েছি, এনবিআর বলেছে এটা পোর্ট হতে সমাধান করে আসতে হবে। পোর্টেও আমরা অ্যাপ্লিকেশন করে, সিস্টেম ফলো করে সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু এটি এখনও সমাধান হয়নি, আমরা হতাশ।’
‘আমরা পণ্য আগে যেভাবে আনতাম এখনও সেভাবে আনছি। এটা আমরা মনে করি মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং, আমরা এসআরও অনুযায়ীই পণ্য আনছি’ বলছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন জানান, ‘কাস্টমস হাউজ ও শুল্ক গোয়েন্দাদের নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট কমিটি গঠন হয়েছে, সেখানেও আমরা গিয়ে বলে আসছি। কমিটি বলেছে, এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ফেভারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দার ফেভারে। তবে অধিকাংশ জায়গায় যে প্রবলেমগুলোকে তারা ধরেছিলো তা কিন্তু আমাদের ফেভারেই গেছে। সেই জায়গা হতে এটি শুধু শুধু আটকে থাকায় আমাদের এই ধরনের ডেমারেজ, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যেতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আনুমানিক ৭০০ কোটি টাকার পার্টস আটকে আছে। যেখানে দেশের ১৪টি কারখানারই কিছু না কিছু পণ্য আটকে রয়েছে। এর বেশির ভাগেরই প্রডাক্টশন হল্ট, প্রডাক্টশন করার মতো ক্যাপাসিটি নেই।’
ফেয়ার গ্রুপের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরো মাসে যদি আমাদের প্রডাক্টশন বন্ধ থাকে তাহলে বাজারে কোনো পণ্য বিক্রি করতে পারছি না। সারা মাসে বেতন দিতে হচ্ছে যেহেতু আমরা লে-অফ করিনি। এটা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি, এটা ইম্পোর্ট তো না। আমাদের কুইক সমাধান না দিলে অনেক সমস্যা হয়।’
পুরো ইন্ডাস্ট্রির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলে, ‘১৪ টি ফ্যাক্টরিতে ১২ হতে ১৫ হাজার কর্মী কাজ করে। এই ১৫ হাজার কর্মীকে ২৫ হতে ২৭ কোটি টাকা বেতন দিতে হচ্ছে, এই বেতন কোনো প্রডাক্টশন না করে দিতে হচ্ছে। আমাকে যে এই সময়ে ডেমারেজ পে করতে হচ্ছে সেটার পরিমাণ এখনও আমরা জানি না । কিন্তু প্রত্যেক কোম্পানিকে বড় অংকের অর্থ ডেমারেজ দিতে হবে। অন্তত ১৫-২০ কোটি টাকা তো হবেই। আবার সরকারও এই সময়ে কোনো রেভিনিউ পাচ্ছে না। এখন দেশের ইন্ডাস্ট্রির কোনো পণ্য বাজারে নেই, অবৈধ পণ্য বাজারে এসে সয়লাভ হয়ে গেছে।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটমকে বলেন, ইতোমধ্যে আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি এ খাতের যে সংগঠন অছে তাদের বলেছি, এটি নিয়ে তারা এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আলোচনা করুক। তাদের আমাকেও চিঠি দিতে বলেছি। আমি আমার মন্ত্রণালয় হতে অফিসিয়ালি অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেবো।
‘এনবিআরকে বুঝতে হবে মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি এই বেআইনি জিনিস কেনো আনবে ? কী প্রয়োজনে আনবে ?’ বলছিলেন তিনি।
কী ব্যাখ্যা কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের :
লিকুইড ক্রিস্টাল মডিউল (এলসিএম) এবং ফ্লেক্সিবেল প্রিন্টেড সার্কিট (এফপিসি) আইটেম দুটি এসআরও ১২৭-আইন/২০২১/১৬/কাস্টমসের টেবিল ২-এ রেয়াতি সুবিধার জন্য পৃথক অবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা। তাই এই আইটেম দুটি একই টেবিলে আলাদাভাবে অন্তুর্ভুক্ত থাকায় এবং এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ করে আইটেম দুটি সংযোজিত অবস্থায় আমদানি করায় রেয়াতি বা সিপিসি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
একইভাবে ক্যামেরা মডিউল এবং ফ্লেক্সিবেল প্রিন্টেড সার্কিট (এফপিসি) ক্ষেত্রেও আইটেম দুটি একই টেবিলে আলাদাভাবে অন্তুর্ভুক্ত থাকায় এবং এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ করে আইটেম দুটি সংযোজিত অবস্থায় আমদানি করায় রেয়াতি বা সিপিসি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
উল্লেখিত ব্যাখ্যা কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. বশীর আহমেদের।
এই ব্যাখ্যা উল্লেখ করে তিনি চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারকে এ বিষয়ে চিঠি দেন যে, এসব পণ্য শুল্কায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা তিনি দেন। যার অনুলিপি সকল কাস্টমস হাউজ, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত সার্কেলকে দেয়া হয়।
চিঠিতে তিনি বলছেন, এ জাতীয় পণ্য চালান পরীক্ষণ, শুল্কায়ন সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা-দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারের প্রচুর রাজস্বহানি হচ্ছে এবং মোবাইল ফোনের শিল্পের বিকাশে প্রণীত এসআরও এর প্রকৃত কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে।
কারখানার উদ্যোক্তা ও আমদানীকারকদের ব্যাখ্যা :
এসআরও তে বলা হয়নি যে, এলসিএম বা ক্যামেরা মডিউলের ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আলাদা আলাদা অবস্থায় আমদানি করতে হবে। এলসিএমের সাথে ইন্ট্রিগ্রেটেড কানেক্টর এফপিসি থাকতে পারবে না বা অসম্পূর্ণ অবস্থায় এলসিএম আমদানি হতে হবে এমন কোনো ইন্ডিকেশন এসআরওতে নেই।
বিষয়টি উল্লেখ করে এমআইওবি বলছে, বাস্তাবিক দৃষ্টিকোন হতে এফপিসি নিজেই এলসিএম এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্যামেরা মডিউলের ক্ষেত্রেও তাই। বিষয়টি বিভিন্ন মোবাইল টেকনোলজি লিটারেচারে আলোচিত। ক্যামেরা মডিউলের প্রধান কম্পোনেন্টের মধ্যে রয়েছে, লেন্স, ইনফারেড ফিল্টার, ইমেজ সেন্সর, ডিজিটাল সিগনাল প্রসেসিং, সফটবোর্ড এফপিসি অন পিসিবি।এতে এফপিসি ইনহাউজ করা থাকে, এটা আলাদা অংশ নয়। এখানে এটি হলো কানেক্টর, সেখানে কীভাবে এটি আলাদা আমদানী করা যাবে।