সম্প্রতি ইসলামি ব্যাংকের ঋণ কেলেংকারীতে সামনে উঠে এসেছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলমের নাম। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ঋণ তুলে নিয়েছে তিনটি ব্যাংক থেকে, যার মধ্যে এক ইসলামি ব্যাংক থেকেই তুলে ন্যেয়া হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। অথচ এর আগেও অনেক দিন ধরেই গ্রুপটি বিদেশে বিনিয়োগ করে আসছে, যা প্রচলিত আইনের খেলাপ।
এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন দুইজনই সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব ধারণ করেন। তারা এই নাগরিকত্ব দেখিয়েই তাদের বিদেশী ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মূলত তারা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেন সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে।
উপরের ছবিটি নেয়া হয়েছে কুয়ালালামপুর-ভিত্তিক কোম্পানি জাহারিন নেক্সক্যাপের ওয়েবসাইট থেকে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ক্যানালি লজিস্টিকস সম্প্রতি কুয়ালামপুরের ফাইভ-স্টার রেনেসাঁ হোটেল ক্রয় করে। যে হোটেলের মার্কেট অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল স্টাডি করে দেয় জাহারিন নেক্সক্যাপ।
সিঙ্গাপুরের ডেটা রেজিস্টার ফর কোম্পানিজের ওয়েবসাইটে ক্যানালি লজিস্টিক্সের নাম সার্চ দিলে কোম্পানি এবং তার সিস্টার কনসার্নের নাম আসে।
প্রতিটা কনসার্নের নিচে এক বাক্যে যা লেখা আছে, এর চাইতে বিস্তারিত আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এসকল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, চকচকে ওয়েবসাইটে বেসিক সার্ভিস ছাড়া আর কোনো তথ্য তেমন নেই।
এরকম একটা বিশাল কোম্পানি যার কয়েকটি হোটেল রয়েছে, তাদের এমন ওয়েবসাইট থাকা অস্বাভাবিক।
২০১৪ সালে ক্যানালি লজিস্টিকসের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের হোটেল গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর ক্রয় করে হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল লিমিটেডের কাছ থেকে। ২৫০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরিয়ান ডলারে সম্পন্ন হয় এই প্রক্রিয়া। যা বাংলাদেশী টাকায় ১৮৮০ কোটি টাকা। এই হোটেলের নেট প্রোফিট ২৮ কোটি টাকা, আর নেট অ্যাসেট ৯৪৮ কোটি টাকা।
ক্যানালি লজিস্টিক্সের নাম পালটানো হয় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই। পরের নাম হয় ভেঞ্চুরা ইন্টারন্যাশনাল। এর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার 201501028492 (1153816-X), ঠিকানা SUITE 6.01 LEVEL 6 WISMA PARADISE NO. 63 JALAN AMPANG, KUALA LUMPUR। আর ব্যবসায়িক ঠিকানা L11-1, 11TH FLOOR, MENARA SENTRAL VISTA, NO. 150, JALAN SULTAN ABDUL SAMAD BRICKFIELDS, KUALA LUMPUR। কোম্পানির মোট ৫০ লাখ শেয়ার, এর মাঝে সাইফুল আলমের শেয়ার ৩৫ লাখ আর তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের শেয়ার ১৫ লাখ।
এদিকে ক্যানালি শিপিং এর নাম পালটানো হয় ৫ ডিসেম্বর ২০২২ সালে। এর বর্তমান নাম উইলকিন্সন লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডার পিকক প্রোপার্টি হোল্ডিংস এবং নিউহ্যাভেন কর্পোরেট সার্ভিস। যা রেজিস্ট্রার করা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। যাদের শেল কোম্পানি নিয়ে ধারণা আছে, তারা এই তথ্যে এই কোম্পানি দুটোকে শেল কোম্পানি হিসেবে সন্দেহ করতে পারেন। পিকক প্রোপার্টি হোল্ডিংস উইলকিন্সনের ৩ কোটি সিঙ্গাপুরিয়ান ডলারের সমমূল্যের শেয়ারের পুরোটার মালিক। আর পিককের পেছনে আছে জার্সি ভিত্তিক আরেক শেল কোম্পানি সানতেরা। সিংগাপুরে উইলকিন্সনের ঠিকানা 80 raffles place UOB Plaza। ২০২০ সালে কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩৩৯.৫ কোটি টাকা।
২০১৬ সালে এস আলম গ্রুপ ভেঞ্চুরা ইন্টারন্যাশনালের নামে কুয়ালালামপুরের পাচ তারা হোটেল রেনেসাঁ কুয়ালালামপুর কিনে নেয়। এই হোটেলটি গত বিশ বছর ধরে পরিচালনা করে আসছিল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল, তারাই আগামী দশ বছরের জন্য হোটেলের দায়িত্ব নেয় আবার। এর জন্য এস আলম গ্রুপ ব্যয় করে ৭৬৫ মিলিয়ন রিঙ্গিট, যা বাংলাদেশী টাকায় ১৭৮৭.৬ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়ার সেরাঙ্গুন প্লাজায় অবস্থিত সেন্ট্রিয়াম স্কয়ার নামের একটি মার্কেট কিনে নেয়। যার জন্য পরিশোধ করে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩৮৭ কোটি টাকা।
জাগোনিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার-১ লিমিটেডকে স্ট্যাম্প ডিউটি (কর) বাবদ ৩ হাজার ১৭০ কোটি ৮৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮০১ টাকা মওকুফ করেছে সরকার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬১২ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট এবং ফাইনান্সিং ডকুমেন্টসের অন্তর্ভুক্ত দলিলাদি রেজিস্ট্রেশনের ওপর আরোপিত স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ এ টাকা মওকুফ করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ সুবিধা দেয়া হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্ট্যাম অ্যাক্ট, ১৮৯৯ এর সেকশন ৯ এর ক্লজ (এ)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন পলিসি অব বাংলাদেশের আওতায় বেসরকারি খাতে এসএস পাওয়ার-১ লিমিটেড কর্তৃক চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬১২ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট এবং ফাইনান্সিং ডকুমেন্টসের অন্তর্ভুক্ত দলিলাদি রেজিস্ট্রেশনের ওপর আরোপিত স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৩ হাজার ১৭০ কোটি ৮৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮০১ টাকা মওকুফ করা হলো।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ২০১৩-২০১৬ সালে দেশ থেকে টাকা বাহিরে বিনিয়োগ করা যেত না। অথচ ২০১৬ সালে এর পরেও সেন্ট্রিয়াম স্কয়ার কিনে নেয় এস আলম গ্রুপ। সেসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শুভঙ্কর সাহা ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম নিউএজ‘কে বলেছিলেন, এস আলম গ্রুপ সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের জন্য অনুমতি নিয়েছে বলে তারা অবগত নন। বাংলাদশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকরা বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারতেন না ২০১৬ সালে। এই ধরনের বিনিয়োগ দেশের প্রচলিত আইনের খেলাপ। সে সময় তদন্তের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল; যা পরে মুখ থুবড়ে পড়ে।
অথচ এস আলম গ্রুপ সেইসময় সিঙ্গাপুরে হোটেলগুলো ক্রয় করতে প্রায় ৬৩৪৫ কোটি টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এর পরেও কেন এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়নি? কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি? এসব আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত না করে উল্টো এই প্রভাবশালী গোষ্ঠির রাজস্ব মওকুফ করা হয়েছে ৩১৭০ কোটি টাকার।
এস আলম গ্রুপের কর্নধার সাইফুল আলম ও তার স্ত্রীর সকল কাগজে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব। সাইপ্রাসের পাসপোর্ট কেনার জন্য ন্যূনতম দুই মিলিয়ন ইউরো বা ২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয় দেশটিতে। এমন বিপুল অর্থ বিদেশে কিভাবে পাঠানো হয়েছে? বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এভাবে বিনিয়োগ করে বৈদেশিক নাগরিকত্ব গ্রহনের কোন সুযোগই নেই, স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিই এই কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এসআলম গ্রুপের মত শক্তিশালী রাঘব-বোয়ালদের জন্যে কি বাংলাদেশে আদৌ কোন আইন অনুসরন করা হয়?