দেশের আমদানি কমলেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি ১১৩%

প্রায় দুই বছর ধরে দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) তা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্যে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর মেয়াদে এ ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি ১১৩ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৮০ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্য ছিল ৩৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪২

হাজার ৮১৮ কোটি টাকার। আর আগের প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারল্য নিয়ে কিছুটা চাপে থাকলেও দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোয় ডলারের প্রবাহ বেশ ভালো। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশই এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেশে আসে। এ কারণে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হিমশিম খেলেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পেরেছে।

দেশে বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক রয়েছে ১০টি। এর বাইরে প্রচলিত ধারার ১৫টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও ১৬টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫ শতাংশ ও মোট বিনিয়োগের (ঋণ) ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৫৪ শতাংশই আসছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়সীমায় দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের। এ ধারার ব্যাংকগুলোর মোট আমদানিতে আল-আরাফাহ্‌র অংশ ছিল ৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ অবদান রেখেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এছাড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট আমদানিতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৯ দশমিক ৫৬, এক্সিম ব্যাংক ৬ দশমিক ৮৬ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ অবদান রেখেছে। এক্ষেত্রে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের অংশগ্রহণ ছিল ১ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে ৭ দশমিক ১৪ ও ইসলামী ব্যাংকিং শাখার মাধ্যমে ৭ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বরাবরই ইসলামী ব্যাংক ‘মার্কেট লিডার’। নানা সংকট ও বিরূপ প্রচারণা সত্ত্বেও আমাদের ব্যাংকের ডলার প্রবাহ ভালো ছিল। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে আমরা পর্যাপ্ত ডলার পেয়েছি। আর আমদানির ক্ষেত্রে আমরা সরকারের নীতি অনুসরণ করেছি। এক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মতো চলতি বছরও ইসলামী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর রফতানি বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশেরও কম বা দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু এ সময়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬২ শতাংশেরও বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৩৪ হাজার ৯৮ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৫৫ হাজার ২৫২ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ শ্লথ। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। কিন্তু এ সময়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ৩৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছে। সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশই এসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমে।

তবে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ জানান, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার ব্যাংক বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান শক্তি হলো রফতানি আয়। এ মুহূর্তে আমাদের ব্যাংকের রফতানি খাত ঋণাত্মক। প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না। মানি এক্সচেঞ্জগুলো ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ চাচ্ছে। যারা বেশি দর দিতে পারছে, তারাই রেমিট্যান্স বেশি আনছে। ডলার সরবরাহ কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না।’

গত অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও আমদানি ১৮ শতাংশের বেশি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক নিজে থেকেও আমদানির এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে।

প্রচলিত ধারার একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, ঘোষিত দরের চেয়ে ১০-১২ টাকা বেশি দিলে তবেই রেমিট্যান্স মিলছে। এ কারণে অনেক ব্যাংকই রেমিট্যান্সের ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ডলার সরবরাহ কমে যাওয়ায় আমদানির এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় ওই ব্যাংকগুলোর পক্ষে আমদানি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।

Bonikbarta