দেশটা আসলে কাদের

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper

  • সালাহউদ্দিন বাবর
  • ০৯ ডিসেম্বর ২০২২

অনেক দিন থেকে বহু বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষসহ বোদ্ধা সমাজের কাছে নানা প্রশ্ন অহর্নিশ ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে ইদানীং একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মানুষ, আসলে এই রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার কারা। দেশের সংবিধানে এর একটা জবাব অবশ্য আছে। সংবিধানের ১৩(ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত আছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত ও সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষের রাষ্ট্রের মালিকানা।’ এর সোজা সাপ্টা ব্যাখ্যা হচ্ছে রাষ্ট্রের সম্পদের মালিকানা দেশের ষোল কোটির অধিক মানুষের। সংবিধানের অন্যত্র (৭(১)) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ এর সহজ সরল অর্থ বাংলাদেশের সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ও সম্পদ জনগণের হাতেই। ক্ষমতার উৎস তারাই। কিন্তু বাস্তবে এখন কে সংবিধানের তোয়াক্কা করে। কিন্তু সংবিধান (যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন) বলছে ২১(১) অনুচ্ছেদে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা…. প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।

সে সুবাদে এ দেশের মালিক-মোক্তার কিন্তু আমজনতা। কিন্তু আজকের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এসব বিধিবিধান যেন ফিকে হয়ে গেছে। আর সেজন্য বারবার এমন প্রশ্নই সৃষ্টি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কোন সে জনগণ? তারা কি সেই লুটেরাদের দল, যারা রাষ্ট্রের সম্পদ পাচার করছে, জনগণের সম্পদ নয়ছয় করে নিজেরা অঢেল সম্পদের অধিকারী হয়েছে। গাড়ি বাড়ি করে আরাম আয়েশে জীবন কাটাচ্ছে। এরাই যত সব ঋণ খেলাপির দল। সমাজ বাস্তবতায় মানুষের ভিতর যে ঘোরের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই দুর্বৃত্তরাই আজ রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাত থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, অর্থ পাচার, অর্থকড়ি আত্মসাতের হাজারো কূটকৌশল এদের জানা এবং অন্ধকার সব অলিগলি এদের চেনা। এই গোষ্ঠী সমাজের একেবারে ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও এরা কিন্তু অত্যন্ত শক্তির অধিকারী। এদের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা যারা চর্চা করেন সেই সব ব্যক্তিদের সাথে তাদের সক্ষমতা ও দহরম মহরমের সম্পর্ক। জনশ্রুতি রয়েছে, ওই সব শক্তিধরদের সাথে দুর্বৃত্তদের ভাগ-বাটোয়ারার সম্পর্কও আছে। বছরের পর বছর ধরে এমন ফোরজারি চলতে থাকার পরও প্রশাসনের আশ্চর্যজনক নিস্পৃহতা রহস্যজনক। দেশের স্বার্থের কথা নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবেন বলে যারা জোর গলায় প্রচার করেন, ওইসব ব্যক্তিই দুর্বৃত্তদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার প্রয়োজনে মুহূর্তেই ভোল পাল্টে দুর্বৃত্তদের লোক দেখানো মন্দ কথাও বলেন। অতীতে এমন বহু ‘গেইম’ তারা খেলেছেন। কিছু মানুষকে ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত করা গেলেও সবাইকে সবসময় সেটা করা যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাদের সেই পুরোনো খেলার মোহাবিষ্ট দর্শক আর নেই।
সে যাই হোক অতি সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালতের মান্যবর বিচারকগণ এমন সব কথা বলেছেন, যা মানুষের হৃদয়ের মর্মমূলকে বিদ্ধ করেছে। যার ভিতর নিহিত রয়েছে আজকের সমাজে ওইসব দুর্বৃত্তের গোষ্ঠীগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট যত বৈষম্য আর অবিচারের আভাস। তাকে সূচাগ্র দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। মান্যবর বিচারপতিগণ ক্ষুব্ধ চিত্তে মন্তব্য করেছেন, ‘২৫ হাজার টাকার জন্য সাধারণ কৃষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ যাদের কাছে পঁচিশ লাখ কোটি টাকা পাওনা তাদের কিছু হয় না। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। কি বিচিত্র হাল আমলের যত বিধি-বিধান! এ জন্য এ কথা বলা হয়েছে, এরাই সেই দুর্বৃত্ত যারা দেশের শক্তিধরদের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়ে যাচ্ছে।

অল্প টাকার জন্য নিরীহ মানুষের কোমরে দড়ি বাঁধার যে পটভূমি সেটা হয়তো অনেক পাঠকের দৃষ্টি গিয়ে থাকতে পারে। সেজন্য তার কিছুটা করুণ অধ্যায় স্মরণ করা যেতে পারে। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পারার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ জন কৃষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ঘটনার পর ৩৭ জনের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ, তাদের সবাইকে একসাথে করে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়। এর সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে। এ বিষয় নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত উষ্মার সাথে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে, আরো জানা গেছে, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলার স্থানীয় কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অভিযোগ করেছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে আছেন অনেকেই, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় না, দরিদ্র কৃষকরা আটক হন, জেলে যান। তিনি বলেন, আমার জানা মতে, ঋণের টাকা তাদের অনেকে বহু আগেই পরিশোধ করেছেন, তার রশিদ তাদের কাছে রয়েছে। এর পরও অকারণেই তাদের কারাগারে পাঠানো হলো।

ব্যাংক থেকে গুরুতর অনিয়ম করে ঋণ নিয়ে সেটা ফেরত না দিয়ে বহালতবিয়তে আছেন অনেকে। অথচ দেশের বহু ব্যাংক এখন এসব কারণে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালত সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন, সেটা এ রকম, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় উচ্চ আদালতের মান্যবর বিচারপতিগণ বলেছেন, ‘সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে- আমরা এসব শুধু কি চেয়ে চেয়ে দেখব, এটা কি হয়? এসব কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন উচ্চ আদালত। আদালত বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন যা করছে তাতে মনে হয়, আমরা নাটক দেখছি। হাততালি দেয়া ছাড়া আর কী করার আছে; না হয় বসে থাকতে হবে।’ দেশের সচেতন মহল এমন পরিস্থিতি নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত সর্বত্র এখন অনিয়ম, অব্যবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে যা কল্পনার বাইরে। মাইলের পর মাইল আবাদি জমিতে যদি পঙ্গপাল পড়ে তবে মুহূর্তেই সব শস্য তুষে পরিণত করে। সেভাবে যেন দুরাচারীরা আজ দেশের সম্পদের ভাণ্ডার শূন্য করে দিচ্ছে। সে জন্য সর্বত্র হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশের এখন সমস্যা সঙ্কটের কোনো অন্ত নাই, সব পাহাড় হয়ে উঠেছে। যেখানেই হাত দেয়া হবে, দেখা যাবে ঝুড়ির আর কোনো তলা নেই, সেখানে যা কিছুই রাখা হচ্ছে অলক্ষ্যে সব পাচার হয়ে যাচ্ছে। খোগলা ঝুড়ির নিচে হাত পেতে বসে আছে সেই সব দুর্বৃত্ত, সব কিছু তারা কুড়িয়ে তুলে নিচ্ছে। উলু পোকা যেমন সব কিছুকে ঝাঁজরা করে ফেলে, আজ রাষ্ট্রকেও তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিককালের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খেলাপিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জন, হালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে তো বটেই। যেমন ২০২০ সালে সেই সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮২ জন। অন্যদিকে চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

প্রশ্ন হলো, কতজন ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অর্থ আদায়ের জন্য কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ প্রতিদিন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আর্থিক খাতের ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি আর নানা কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ মাত্র ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ১২ জন কৃষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংবিধানে রয়েছে (সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ) সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এর পরের অনুচ্ছেদে রয়েছে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্ম স্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। কিন্তু এসব সাংবিধানিক অধিকার কোথায় লুকিয়েছে, বা কার্যকর হচ্ছে না কেন। পাবনায় কৃষকদের নিয়ে এতবড় ঘটনা ঘটল অথচ কারো নজরে আসেনি, এটা হতে পারে না। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলা বা উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্প মালিক, বণিক সমিতি থেকে শুরু করে কেউ এমন মর্মান্তিক ঘটনাটি জানবে না, কেন প্রতিকারে এগিয়ে আসবে না; ভাবতে অবাক লাগে। জানলেও হয়তো বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দেননি। কৃষক বলে তো কথা।

বিদেশী এক সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর দেশের এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। আমদানি রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থপাচার মনিটরিং সংস্থা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এখন ২০২২ সালে শেষের দিকে এই অঙ্ক অনেকটা বেড়েছে কোনো সন্দেহ নেই।

টাকা বিদেশে পাচার করছে কারা এটা তো সবার জানা, অথচ এদের জাতীয় অর্থনীতিতে কোনো অবদান নেই। অথচ জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৮ শতাংশের মতো। সাধারণ কৃষকদের ঘামেই এই অবদান জাতীয় অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট করে চলেছে। অথচ বিনিময়ে তারা আজ চরম অবহেলা আর বৈষম্যের শিকার। ন্যায়বিচার, নীতি নৈতিকতার দিক থেকে কত গর্হিত এসব কাজ। আজকের সব দিক থেকে জাতি দ্রুত অগ্রগতির দিকে ধাবমান। নীতি নৈতিকতার চর্চাই কেবল জাতিকে উদ্ধার করে আনতে পারে। নীতি নৈতিকতা ও আদর্শের সংজ্ঞা ও বিস্তৃতির পরিধি শাশ্বত, চিরন্তন। আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে। কিন্তু দেশের এখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বুঝতে বেশ খটকা লাগছে। শিক্ষা ও নৈতিকতা একটি অপরটির সাথে জড়িত। শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। আর নৈতিকতা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে সত্য ও ন্যায়কে বুঝতে শেখায়। কিন্তু সেটা কী আদৌ আমাদের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হচ্ছে।

[email protected]